মোঃ শফিকুল আলম
চায়নার টোটালিটারিয়ান রেজিম দিন শেষে গনতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে সহাবস্থান করতে পারেনা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ জুলাই, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:০৪ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া বেশ সমালোচনা করেছে। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন এর ওপরের শিরোনামে লেখাটি নিয়ে আজকের মূলত আলোচনা।
বিশ্লেষক Ambrose Evans এর মতে এই শতকের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূনরায় বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইকোনোমিক সুপার পাওয়ারে রূপান্তরিত হবে। তবে তার সাথে চায়নার বেশ কিছু বছর অর্থনীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার বোগাস আওয়াজ এবং পরিশেষে চায়নার অর্থনৈতিক ধ্বস নামার সাথে তুল্য হবেনা।
চাইনিজ কমিউনিজম ত্যাগ করে যেসব রাজনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ চায়নার বাইরের দেশে অবস্থান করছেন তারা চাইনিজ রেজিমকে বিশ্বের জন্য মারাত্মক হিসেবে রন্জিত করছেন। Cai Xia একজন কমিউনিজম পক্ষ ত্যাগকারী মনে করেন এই চাইনিজ রেজিম যতো দিন যাবে ততো মারাত্মক হবে। এবং ভয়াবহ রূপ ধারন করবে।
অধ্যাপক Cai সেন্ট্রাল পার্টি স্কুল যেটাকে কমিউনিস্ট এলিটদের পবিত্রতম স্থান মনে করা হয় সেখানে ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে কমিউনিস্ট ক্যাডারদেরকে পুরোটা সময় শিক্ষা দিতে হয়েছে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নেকড়েদের জীবেনযাত্রার সাথে কমিউনিস্ট জীবনযাত্রাকে কখনো মেলানো যাবেনা।
তাঁর (Cai) চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির ওপর (Ideological Reflexes) একটি দীর্ঘ প্রবন্ধের প্রকাশনা রয়েছে যেটি প্রকাশ করেছে Hoover Institution। প্রবন্ধটিতে চায়নার টোটালিটারিয়ান রেজিমের অসংস্কারযোগ্য অশুদ্ধ চরিত্রের যথাযথ প্রকাশ রয়েছে। এই প্রবন্ধে পশ্চিমা বিশ্বের গত ৪০ বছর ধরে প্রতিনিয়ত চায়নাকে গনতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার ধারাবাহিক ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথাও বলা হয়েছে।
Cai বলেন, “চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কারও সংযুক্তিকরন হতে পারেনা। এই পার্টি পুরোপুরি অনমোনীয়ভাবে শত্রুতা করে বা অন্যকে শত্রু মনে করে। গনতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র কখনো সমন্বিত করা যাবেনা বা সুনির্দিষ্টভাবে সহাবস্থান করতে পারবেনা।”
“নতুবা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (CCP) পশ্চিমা গনতন্ত্রের সাথে আদৌ সহাবস্থান করতে চায়না। Cai’র মতে, ২০০৮ এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় থেকে চায়না মনে করছে আমেরিকা আর এই অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেনা। অপর পক্ষে চাইনিজ কমিউনিজম বরং অর্থনৈতিক মন্দা যোগ্যতার সাথে মোকাবেলা করে বিশ্বে সুপিরিওরিটি অর্জন করেছে। Cai’র মতে চায়নার এই ভুল assessment বরং চায়নাকে মিথ্যে superiority complex এ ভুগতে সহযোগিতা করছে।
এর ফলে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (CCP) আবার এককভাবে গনতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে ধীরে ধীরে যতোটুকুন সংযুক্তি তৈরী হয়েছিলো তা’ বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে।
পরিশেষে ঐতিহাসিক বিশ্লেষকগন বলতে পারবেন চায়না বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে বা অবিবেচনাপ্রসূত বিনিয়োগ পদ্ধতি অনুসরন করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বন্ধের প্রক্রিয়ায় কতোটা সফলতা পেয়েছে। ২০০৮ সালে Lehman Brothers (অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান) আমেরিকায় প্রোপার্টি মার্কেটে ধ্বস নামায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া ঘোষিত হয় যেখানে এই প্রতিষ্ঠানে চায়নার বিনিয়োগ ছিলো এবং চায়না ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চায়না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দু’দিক থেকে একদিকে অর্থ হারিয়েছে; অন্যদিকে এই অর্থ নিজ দেশের শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ না করায় উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অংক অনুযায়ী পশ্চিমা অর্থনীতির সাথে catch up করতে চায়নার উৎপাদন ক্ষমতার হার হতে হবে ৩% যার বিপরীতে পশ্চিমা অর্থনীতির উৎপাদন ক্ষমতা হবে ০.৭%। ২০০০ সালের পর থেকে চায়নার বরং উৎপাদন ক্ষমতা ৩% এর নীচে নেমে গেছে। কারন তারা সহজ উপায়ে অর্থ ঋণ দিয়ে অর্থ উপার্জনের ভুল কৌশল অবলম্বন করেছে। যাদেরকে ঋণ দিয়েছে তারা বরং দেউলিয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং এবং তাঁর টপ ক্যাডারগন অবশ্য মনে করেন তাঁরা এই অসম্ভব বৈপরীত্য কাটিয়ে উঠতে পারবেন ২৪ ঘন্টা অতন্ত্র তত্বাবধান নিশ্চিত করে একটি ভাইব্রান্ট হাইটেক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে। সি জিনপিং এর এই লৌহমানবতাপূর্ণ পলিসি বরং সাবেক নেতা ডেং এবং হু’র অপেক্ষাকৃত কোমল নীতির থেকে সরে আসা। অর্থাৎ চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি তার মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন আনায়নে পুরোপুরি অনাগ্রহী। পার্টি বরং মুখোশ পরিবর্তন করে ডেং এর সেই পলিসি ‘bide your time and hide your strength’ যার philosophical অর্থ হচ্ছে আসল শক্তিমত্তা লুকিয়ে নিজেকে অপক্ষাকৃত দুর্বল দেখানো নীতি গ্রহন করেছে। অপর পক্ষে দেশের অভ্যন্তরে টোটালিটারিয়ান কন্ট্রোল পলিসি গ্রহন করেছে। অনেকটা হিটলার এবং স্ট্যালিনের স্বাপ্নিক পথে এগুচ্ছে। টেকনোলজি ব্যবহার করে সরকার বরং বিরুদ্ধ মতবাদকে সার্বক্ষণিক নজরদারীতে রাখছে।
সি জিনপিং এর সাম্প্রতিক সাউথ চায়না সমুদ্র নীতি, হংকং এ বিদ্রোহ দমনে নির্দয় আচরন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার সাথে আগ্রাসী মনোভাব, উইঘরে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার, কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্বকে যথাযথ তথ্য সরবরাহ না করা ইত্যাদি চায়নার স্বৈরতান্ত্রিক আচরনকে আরও স্পষ্ট করে।
চাইনিজ নেতা ডেং এর অর্থনৈতিক পলিসির ওপর গনতান্ত্রিক বিশ্ব দীর্ঘদিন একটি ভুলের ওপর ছিলো। বিল ক্লিন্টন এমনকি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে চায়নার আরোহনকে চাইনিজ অর্থনীতির গনতন্ত্রায়নও ভেবেছিলেন। চায়না সম্পর্কে বরং পশ্চিমা অর্থনীতিকগন, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব অনেকদিন পর্যন্ত ভুলের মধ্যে অবস্থান করেছে। Cai পশ্চিমা বিশ্বকে মনে করিয়ে দিতে চান যে চায়নাকে ওপর থেকে যা’ দেখা যাচ্ছে চায়না তার চেয়ে বরং ভঙ্গুর। এমনকি সোভিয়েট রেজিমের ভগ্নদশা থেকেও ভঙ্গুর। Cai মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে চাইনিজ কমিউনিজমের ভগ্নদশায় বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাব মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলছেন।
শুধু ঋণ ব্যবসায় সম্পৃক্তি নয়, দুর্নীতির বিস্তার নয় রয়েছে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রচারনা এবং সামাজিক বাস্তবতায় ফারাক অমিল। রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং একজন চরম সন্দেহ প্রবন মানুষ। অত্যন্ত সংকীর্ণ মনের ব্যক্তিত্ব। ধারাবাহিকভাবে বিরুদ্ধমতের লোকদের পার্টি থেকে বিতারন করে চলছেন। ফলে পার্টির মধ্য এবং উঁচু স্তরের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরী করেছে।
Cai বলেন বিশ্বের সবাই অনিরাপদ বোধ করছেন। চায়নার লুন্ঠনকারী মহাজন কারবারীর কার্যক্রম বিশ্ব অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট সে কারনেই চায়নায় সি জিনপিং এর নেতৃত্ব ২০২২ এর পর আর কামনা করেনা। তারা ২০২২ এর ২০ তম পার্টি কংগ্রেসে সি জিনপিং এর পরিবর্তন চায়। পার্টির অভ্যন্তরীণ অসেন্তোষ এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে চায়। বহির্বিশ্বের চাপ এবং অভ্যন্তরীণ নানান ক্রাইসিস সমন্বিতভাবে সি জিনপিং এর নেতৃত্বের অবসান ঘটাতে পারে।
সাবেক ব্রিটিশ কুটনীতিক রজার গারসাইড বলেন চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি ওয়ার্ল্ড সুপ্রিম্যাসির ভারে নূহ্য। তাঁর মতে আরো শক্তি গ্রহনের পূর্বে এখনই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া উচিত। তাঁর মতে এই শতাব্দীর স্বৈরশাসক সি জিনপিং মূলত: গনতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতা পরিমাপে ভুল করছেন।
চাইনিজ নেতা সুনির্দিষ্টভাবে আমেরিকাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছেন। আমেরিকা যখন মনে করে তাদের বিশ্বাস এবং বন্ধুত্বের পাথে ঘাতকতা করা হয়েছে তখন কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে ছাড় দেয়না।
চাইনিজ প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং এবং পার্টি নিউক্লিয়াসের কেউ কেউ এই বিপদ আঁচ করতে পেরেছেন। তারা এও মনে করেন আমেরিকা এবং তার এ্যালায়েন্সের সাথে লেগে পরিশেষে জয়লাভ করা যাবেনা। আমেরিকা যখন তাদের বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া চায়নাকে দেখাতে শুরু করবে তখন হয়তো লি কেকিয়াংরা তাঁদের অভ্যন্তরীণ মাসল শো করে সি জিনপিং রাজত্বের অবসান ঘটাতে পারেন।
আমেরিকার অর্থনৈতিক মাসল শো করা শুরু হতে পারে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেইন্জ থেকে চায়নার ২৫০টি কোম্পানির ডিলিস্টিং করার মাধ্যমে। অবশ্য কোম্পানিগুলো নিজেরাই অনেকটা পর্যদস্তু।
সি জিনপিং-মডেল অর্থনীতির অসংলগ্নতা, বৈপরীত্য, অধিক নিয়ন্ত্রন চাইনিজ অর্থনীতির গতি বা প্রাণরস রুদ্ধ করবে।
সি জিনপিং রাষ্ট্র মালিকানাধীন ভঙ্গুর কোম্পানিগুলোর সংস্কার সাধনের চেষ্টা করছেন যা’ সবাই মনে করেন পার্টির দুর্নীতিবীজদের এবং তাঁর সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। অর্থনীতিতে গতি আসবেনা। এই কর্মসূচী ডেং লিগাসির বিপরীত। ডেং এর অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীর বিপরীত যা’ আবার চায়নাকে অন্ধকার যুগে টেনে নেয়ার সামিল হবে।
সুদিকারবারী করায় দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্হান কমছে। প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন ওয়ার্কফোর্স কমছে। ২০৩০ এ গিয়ে ওয়ার্কফোর্স কমার বাৎসরিক হার হবে ০.৫%।
বাহ্যত কিছু সময়ের জন্য চাইনিজ অর্থনীতি আমেরিকার অর্থনীতিকে ওভারটেক করতে পারে; কিন্তু স্বল্প সময়ে প্রক্রিয়া পুরোটাই বিপরীত হবে। এ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকা হবে বিশ্বে একমাত্র অপ্রতিরোধ্য ইকোনোমিক সুপার পাওয়ার।
স্বল্পকালীন চাইনিজ অর্থনীতির উত্থানের পরপরই ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ভিত্তির কারনে চাইনিজ অর্থনীতির ধ্বস নামতে বাধ্য।