মোঃ শফিকুল আলম
জিরো-কার্বন অর্থনীতি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:০৮ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
জিরো-কার্বন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হবে লাভজনক এবং একই সংগে পৃথিবীকে নেট জিরো দূষণমুক্ত রাখা নিশ্চিত করবে।
বিনিয়োগ জগতে সমস্বরে উচ্চারিত ধ্বনি হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে ক্লাইমেট-প্রুফ হওয়ার। অন্যথায় বিনিয়োগকারীদের সম্ভাব্য জিরো-কার্বন অর্থনীতিতে টিকে থাকার ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। অর্থাৎ পরিবর্তিত অর্থনীতিতে তাদের বিনিয়োগকৃত পোর্টফোলিও লোকসানের সম্মুখীন হবে বা বিনিয়োগকৃত পোর্টফোলিও প্রোফিটাবল হবেনা। বিনিয়োগকারীগন পুঁজি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।
২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশ দূষণ শূন্যে নামিয়ে আনতে সরকারগুলো জরুরী ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহন করছে তারই মধ্যে লাভজনক বিনিয়োগের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইন্জ (IPCC) মনে করে অনুমিত সময়ের এক দশক পূর্বেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী বৃদ্ধি পাবে যেটাকে বিজ্ঞানীরা টিপিং পয়েন্ট বলে থাকেন। সুতরাং এই টিপিং পয়েন্ট আমরা স্পর্শ করতে চাইনা। তাই বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০৫০ এর মধ্যে নেট-জিরোতে পৌঁছানোর জন্য বিনিয়োগ চলছে এবং এই খাতে বিনিয়োগ অবশ্যই লাভজনক হবে।
অস্ট্রেলিয়া শূন্যদূষণ টার্গেট অর্জনে ২০১৫ তে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে তা’ হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা ২০০৫ এর দূষণমাত্রা থেকে ২৬%-২৮% কমিয়ে আনবে।
পৃথিবীকে ডিকার্বোনাইড বা দূষণমুক্ত করতে অনুমিত বিনিয়োগ হবে ইউএস ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগকারীদের জন্য এই খাতে বিনিয়োগ হবে একটা দুর্লভ সুযোগ। আরও থাকছে পৃথিবীকে নেটজিরো দূষণে ফিরিয়ে নেয়ারও বিরল সুযোগ।
Munro Partners অন্যতম পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক James Tsinidis বলেন, “ইন্টারনেট শুরু হওয়ার পর জলবায়ু পরিবর্তনে বিনিয়োগ হবে পরবর্তী সব চেয়ে বড় সুযোগ। এমনকি বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এটি মেগা-ট্রেন্ড তৈরী করবে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা দীর্ঘ S-curve(a mathematical graph that depicts relevant cumulative data for a project) এর শুরুতে আরোহন করেছি। এটি হবে দশকব্যাপী গ্রোথ ট্রেন্ড এবং টেকসই উন্নয়ন রেখা।”
Tsinidis অবশ্য দশকব্যাপী বিনিয়োগের সম্ভাব্য ঝুঁকির ওপরও নজর রাখছেন। তবে তিনি আশাবাদী এই কারনে যে বিশ্বব্যাপী সকল রাজনীতিকগন জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বে কি পরিমান ক্ষতি সাধিত হতে পারে সে ব্যাপারটি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।
Tsinidis বলেন, “আমরা গত ৩ বছর বিভিন্ন সেক্টরের কোম্পানীগুলোর ব্যবস্থাপকগনের সাথে মিটিং করে বিনিয়োগ সুবিধাদি বর্ননা করেছি। ফলে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বা বিভিন্ন প্রকাশনায় ক্লাইমেট চেইন্জ খাতে বিনিয়োগ-ডাটা প্রকাশিত হচ্ছে। একইভাবে বিশ্বের অধিকাংশ সরকার এই খাতে বিনিয়োগ সুযোগ এবং বিনিয়োগ ডাটা প্রকাশ করছে। বিনিয়োগ শিল্পগুলোও ব্যাপকহারে পরিবেশ খাতে, সামাজিক খাতে এবং জিরো দূষণ অর্জনে বিনিয়োগের ফিরিস্তি প্রকাশ করে আসছে।”
এই বিপ্লবে কর্পোরেট অস্ট্রেলিয়া দ্রুত সংযুক্ত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার টপ ১০০ লিস্টেড কোম্পানীর ৫৪% এবং টপ ২০০ কোম্পানীর ৩৮% নেটজিরো টার্গেটে বিনিয়োগ করেছে।
বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা Schroders জলবায়ু পরিবর্তনে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে সব সময় উচ্চ কন্ঠে রয়েছে। Firm’s Australian Operations এর সিইও Sam Halliban বলেন জিরোদূষণ টার্গেট অর্জনে বিনিয়োগ একবিংশ শতাব্দীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যু। Fixed Income and Multi-Asset এর Simon Doyle বলেন, “এটা অপরিহার্য যে ক্লাইমেট চেইন্জ খাতে বিনিয়োগ কতোটা বিনিয়োগকারীদের সুযোগ তৈরী করবে বা ঝুঁকিতে ফেলবে তা’ নির্ভর করবে এ্যাসেট এ্যালোকেশন ডিসিশনের ওপর।”
Simon আরও বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনে পুঁজি বিনিয়োগ ধারনা এবং ঝুঁকি গ্রহন পুঁজি বিনিয়োগ ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক ধারনা। এটি আমাদেরকে অন্যান্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্লাইমেট ঝুঁকির কথা মনে করিয়ে দেয়।”
বিশ্বব্যাপী দেশসমূহের এবং কর্পোরেট জগতের জিরোদূষণ টার্গেট অর্জনে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের এক-কেন্দ্রাভিমুখতা যেমন জিরোদূষণ টার্গেট অর্জনে সাহায্য করবে; তেমনই বিনিয়োগকে লাভজনক করবে।
ট্রিলিয়নস ডলার এক্সপেনডিচার বিভিন্ন সেক্টরে বিন্যস্ত হলে বিনিয়োগকারীগনের জন্য নানান বিনিয়োগ অপশনস তৈরী হবে।
বিনিয়োগ কুশলী Giselle Roux তদুপর সতর্ক করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহনে ম্যাক্রো এ্যাপ্রোচ গ্রহনের কথা বলেন। শুধুমাত্র ক্লাইমেট চেইন্জ মাথায় রেখে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে ঝাপিয়ে পড়লে কোম্পানীগুলো অন্যান্য আসপেক্টস(কর্পোরেট গভর্নেস অথবা ভ্যালুয়েশন) মাথায় না রাখার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ক্লাইমেট চেইন্জসহ সকল ক্রাইটেরিয়া অনুসরন করতে হবে।
যেমন এবছর যখন পুঁজিবাজারে ETFs(Exchange Traded Funds) সবাই একই স্টক পাওয়ার জন্য দৌড়াতে থাকায় স্টক শর্টেজ দেখা দেয় ফলে পারফর্মেন্স ড্রপ করে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ রোধে অনুমিত ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ২৫% ব্যয়িত হবে এনার্জি এফিসিয়েন্সির ওপর।
Munro Partners নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেইন্জ-লিস্টেড Trane Technologies এর সত্বাধিকারী। এই কোম্পানীর স্বল্প-দূষণ হিটিং এবং কুলিং প্রোডাক্টস কমার্সিয়াল এবং অফিস বিল্ডিং এর এনার্জি এফিসিয়েন্সি রেটও সহনীয় মাত্রায় রাখতে সাহায্য করে।
১৮% ব্যয়িত হবে রিনিউয়াবল এনার্জি খাতে। ইউএসএ NextEra কোম্পানী সবচাইতে বড় রিনিউয়াবল এনার্জি ডেভলপার। Vestas বিশ্বের সবচাইতে বড় উইন্ড টারবাইন বিজনেস।
১৮% ব্যয়িত হবে ইলেক্ট্রিক যানবাহন বা ক্লিন ট্রান্সপোর্ট খাতে। এখানে ব্যাটারী চালিত গাড়ী এবং ব্যাটারী সাপ্লাইয়ার্স ইন্ডাস্ট্রীও তৈরী হবে। যেমন সাউথ কোরিয়ার Samsung SDI.
ইউএস ইনভেস্টমেন্ট জায়ান্ট BlackRock ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে অস্ট্রেলিয়ান ইলেক্ট্রিক ভেহিকল চার্জিং প্রোভাইডার JOLT এর মাধ্যমে। JOLT এর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা দ্রুত শুরু করতে BlackRock এর অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনায়োগে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় ৫,০০০ চার্জিং স্টেশন স্থাপনে সহায়তা করছে।
এশিয়া-প্যাসিফিক জোনে Black Rock Real Assets এর ইলেক্ট্রিক ভোল্ট (EV) চার্জিং সেক্টরে এই প্রথম বিনিয়োগ। এবং রিনিউয়াবল এনার্জি সেক্টরে Black Rock এর বিনিয়োগ এখন ৪.৮ বিলিয়ন ডলার।
জলবায়ুর পরিবর্তন অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরী করে। সুতরাং পরিবেশ দূষণ রোধে বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক হয়েছে। সুতরাং বিনিয়োগকারীদের সরকারগুলোর নেটজিরো পলিসির সাথে সামন্জস্যতা রেখে পোর্টফোলিও নির্ধারন করতে হবে।
Black Rock তাই ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট সেক্টর যেমন টেকনোলজি এবং হেলথ কেয়ারে বেশি বেশি তাদের হোল্ডিংস নিশ্চিত করছে। এই বিনিয়োগ লাভজনক হবে বলেই তারা মনে করে। তারা এও মনে করে কার্বন জেনারেট করে এমন এনার্জি বা ইউটিলিটি সেক্টরে বিনিয়োগ বরং বিশ্বকে চিন্তার স্বল্পতায় ভোগাবে এবং বিনিয়োগকারীগন তাদের বিনিয়োগ হারাবে।