রাশেদুল ইসলাম
জীবন পরিক্রমা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ মে, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন তার কোন নাম থাকেনা । যারা তাকে দেখতে আসে, তারা জানতে চায় শিশুটি কোথায় । এই শিশু ধীরে ধীরে বড় হয় । কৈশোর, যৌবনকাল পেরিয়ে বৃদ্ধ হয় । এরপর যখন সে মারা যায়, তখনও তার কোন নাম থাকে না । যারা তাকে দেখতে আসে, জানতে চায় লাশটি কোথায় । মানুষের এই জীবন পরিক্রমা কেমন যেন রহস্যময় । মানুষের জন্মকালের সাথে মৃত্যুকালের কেমন যেন অদ্ভুত একটা মিল আছে ।
শিশুকালে একটি শিশুর শরীর নরম তুলতুলে থাকে । একজন অতি বৃদ্ধ মানুষের শরীরও নরম তুলতুলে হয় । শিশুর গালে দাঁত থাকে না; একজন অতিবৃদ্ধ মানুষের গালেও দাঁত থাকে না । পোশাক ছাড়াই একজন শিশু জন্ম নেয় । আবার বৃদ্ধ বয়সে সে যখন মারা যায়, তখন তার পরিধেয় পোশাক সব খুলে নেওয়া হয় ।
মানুষের কিশোর বয়সটা অনেক কৌতূহলের । সমবয়সী ছেলেমেয়েরা তার খেলার সাথী । তারাই সবকিছু । ঘরে থাকতে মন চায় না । বয়সের এক পর্যায়ে মানুষ কেন যেন আবার সেই কিশোর বয়সে ফিরে যেতে চায় । সেই বাধাহীন বয়স ফিরে পেতে চায় সে । কিন্তু বাস্তবে তা আর হয়ে ওঠে না । কিন্তু মন কি বাঁধা মানে ? মন ঠিকই বার বার ছুটে যাই সেই কৈশোরে । অনাড়ম্বর কৈশোরে । জানতে চায় সেই সঙ্গীরা এখন কে, কোথায় ?
আমি নিজে এখন ঠিক সেই বয়সে; যখন মানুষ কিশোর হতে চায়; কিশোর বয়সে ফিরে যেতে চায় । কিশোর বয়সের সাথীদের মনে মনে খোঁজে সে । এরপর বৃদ্ধ বয়সের সেই শিশুকাল । তারপর শেষ । সব শেষ । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ,
’চুকিয়ে দেব বেচাকেনা,
মিটিয়ে দেবো গো;
মিটিয়ে দেবো লেনাদেনা,
সাঙ্গ হবে আনাগোনা এই বাটে‘ ।
আমি বলছিলাম আমার কৈশোর স্মৃতির কথা । এই স্মৃতিতে নাড়া দেয় আমার বন্ধু নুর ইসলাম । নুর ইসলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল । আমি প্রথম, সে দ্বিতীয় । নাসির তৃতীয় । কিন্তু এই প্রথম হওয়ার গল্প আমাকে পরবর্তীতে অনেক বিব্রত করেছে । কখনো মাথা উঁচু করে বলতে পারিনি যে, আমি ক্লাসে ফার্স্ট ছিলাম । একবার হাইস্কুলে এই কথা বলাতে গোলাম স্যার আমাকে একেবারে হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেন । আসলে স্যারের প্রশ্ন ছিল আমরা যারা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, তাদের মধ্যে কতজন পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছি । উত্তরে অন্যদের সাথে আমি নিজেও হাত তুলি । স্যারের পরের প্রশ্ন ছিল, কতজনের মধ্যে ? আমি বলি তিন জন । তখনই ক্লাসের মধ্যে হাসির রোল ওঠে । তবে এটা আমার আজকের লেখার বিষয় নয় । আমার লেখার বিষয় নুর ইসলাম । আমার সহপাঠী । পঞ্চম শ্রেণিতে আমি প্রথম, আর সে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে ।
আমি ১৯৭৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিই । চৌগাছা হাইস্কুলে সেবার প্রথম সেন্টার হয় । নুর ইসলাম অন্য স্কুল থেকে একইসাথে আমার সাথে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে ফেল করে । তারপর বহু বছর নুর ইসলামের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই । বোধহয় ৩০/৩৫ বছর পর নুর ইসলাম আমাকে ফোন করে । সে জানায়, তার ছেলে অনেক মেধাবী । এসএসসি, এইচএসসিতে তার পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ অনেক গণ্যমান্য মানুষ তার বাড়িতে গেছেন । সবাই তার ছেলের প্রশংসা করেছেন ।
নুর ইসলামের টেলিফোন আমাকে বেশ অবাক করে । আমার মনে হয়েছে এত বছর সে ইচ্ছে করেই আমার সাথে যোগাযোগ করেনি । তারমানে ছেলেবেলার সেই প্রতিযোগিতা সে ভোলেনি । ক্লাসে আমি প্রথম, আর সে দ্বিতীয় । নিজে সে আমার সমকক্ষ হতে পারেনি । কিন্তু যখন তার ছেলে নিজের মেধা ও যোগ্যতা বলে সকলের প্রশংসা পেয়েছে, তখন তার মনে হয়েছে আমার সাথে কথা বলা যায় । কি বিচিত্র মানুষের মনস্তত্ত্ব !
নুর ইসলাম ১৯৮১ সালে কাজের সন্ধানে খুলনা চলে যায় । অনেক হাঁটাহাঁটি করে একটি কার্গো জাহাজে নাবিকের কাজ পায় সে। বেতন মাসিক ২ হাজার টাকা । তখন চালের কেজি ছিল ১২ টাকা । ২০২১ সালে তার সেই বেতন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২ হাজার টাকা । এখন মোটা চালের দাম কমপক্ষে ৪০ টাকা কেজি । এই করোনা কালে তার কাজ বন্ধ । স্ত্রী ৩ মাস আগে মারা গেছে । শরীরটা আগের মত সায় দেয় না । জাহাজের কাজে আর যেতে ভালো লাগেনা । ছেলেটি বুয়েটের ছাত্র । এখন বন্ধ । বাবার সাথে বাড়িতে থাকে । টিউশনি করে যা পায়, তাই দিয়ে বাপবেটা চলে ।
নুর ইসলামেরও আমার মত বয়সের কৈশোর কাল চলছে । ছেলেবেলার কথা ভাবতে ভালো লাগে তার । আমার ছোটকালের ঢিলেঢালা প্যান্ট পরার কথা তার মনে পড়ে । কিশোর বেলার স্মৃতি তাকেও নাড়া দেয় । এরপর আমাদের দুজনেরই বৃদ্ধ বয়সের শিশুকাল শুরু হবে । তারপর শেষ । একদম শেষ ।
জীবন যদি প্রতিযোগিতার হয় তাহলে দিন শেষে কে জিতবে ?
আমি, না নুর ইসলাম ? এখানে হিসেবের মাপকাঠি কি হবে ?
নুর ইসলামসহ সকল শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ১ লা মে, ২০২১ ।