রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (চৌদ্দ)
প্রকাশ: ০১:৫৪ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমি ‘বর্ধমান হাউজ’ এর সামনে । ‘বর্ধমান হাউজ’ নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত নাম নয় । তারচেয়ে বলা ভালো যে, আমি এখন ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের সামনে । এটাও বোধহয় তেমন পরিচিত নয় । তবে বাংলা একাডেমী সবার পরিচিত । আবার এটাও সবার জানা যে, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবীতে বাংলার কতিপয় অকুতোভয় দামাল ছেলেদের বুকের তাজা রক্ত বিসর্জনের কারণেই পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য হয় । তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী উদ্বোধন করা হয় । ‘বর্ধমান হাউজ’ সেদিনই বাংলা একাডেমী ভবন নামে পরিচতি পায় । ২০১০ সালে ‘বর্ধমান হাউজ’এর ৪টি কক্ষ নিয়ে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয় । ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের নিরব সাক্ষী এই বর্ধমান হাউজ ।
যতদূর জানা যায়, ‘বর্ধমান হাউজ’ ১৯০৫ সালের দিকে নির্মিত । বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় ঢাকাকে পূর্ববাংলা ও আসামের রাজধানী করা হলে মোঘল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন সম্বলিত এই ভবনটি নির্মাণ করা হয় । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল এই ‘বর্ধমান হাউজ’ । ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যে একটি দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এমন বিলাসবহুল বাসায় থাকবেন না । সেখানে বাংলাভাষার গবেষণাগার করতে হবে । তারমানে তৎকালে ‘বর্ধমান হাউজ’ ঢাকার অন্যতম একটি অভিজাত ও বিলাসবহুল ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল । তবে ভবনটির নাম ‘বর্ধমান হাউজ’ ছিল না । ব্রিটিশ শাসন পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ মাহতাব ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই বাড়িতে বসবাস করেন । বর্ধমানের মহারাজার বসবাসের কারণেই ভবনটি ‘বর্ধমান হাউজ’ নামে পরিচিতি পায় । এই ‘বর্ধমান হাউজ’ প্রাঙ্গনের বটতলায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র শুভ সূচনা করেন জনাব চিত্তরঞ্জন সাহা ।
একটি ব্যক্তি উদ্যোগ কিভাবে যে জাতীয় উদ্যোগে পরিণত হয় এবং কিভাবে তার দ্যুতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে- তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এই চিত্তরঞ্জন সাহা । চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘বর্ধমান হাউজ’ প্রাঙ্গনের বটতলায় ৩২ টি বই সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন । বইগুলো বাংলাদেশী শরণার্থীদের লেখা এবং স্বাধীন বাংলা সাহিত্যপরিষদ থেকে প্রকাশিত । ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জনাব চিত্তরঞ্জন সাহা একাই বইমেলা চালিয়ে যান । এরপর একে একে অনেকেই তাঁর সাথে যোগ দেন । ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমী আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ শুরু করে । সেই ৩২ টি বইয়ের ক্ষুদ্রমেলা কালক্রমে বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয় । ২০১৪ সাল থেকে মাসব্যাপী চলা এই বইমেলার পরিধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে । ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ প্রবর্তনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁদের সকলের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি ।
মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের কারণে বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তার স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ । কিছুটা ঘুরপাক খেয়েই আমি তিন নেতার মাজারের সামনে যাই । স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগের তিন বিখ্যাত নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত । একজন পাঠকের অভিযোগ আমার লেখায় শুধু তিন নেতার মিলের কথা বলা হয়েছে । তাঁদের মধ্যে অমিলের কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি । কথাটা সত্য । তিন নেতার কথা বললে, শুধু তাঁদের মিলের কথাই নয়, ঐতিহাসিক কারণে তাঁদের মধ্যে অমিলের কথাগুলোও উল্লেখ করা দরকার ।
তিন নেতার মধ্যে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পূর্ববঙ্গের সন্তান । এদেশের আলো, কাদামাটি গায়ে মেখে, কৃষক শ্রমিক মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালাবাসা নিয়ে বড় হয়েছেন তিনি । আজীবন দুঃখী বাংলার মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন । মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর দাফন করা হয় । হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম পূর্ববঙ্গে না হলেও, বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, ত্যাগ ও তিতিক্ষা আকাশছোঁয়া । ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের বৈরুতে চিকিৎসারত অবস্থায় তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয় । পূর্ববাংলার মানুষের ভালবাসায় সিক্ত এই মহান নেতাকে শেরে বাংলা ফজলুল হকের পাশে সমাহিত করা হয় । এই দুই নেতার পাশাপাশি সমাহিত তৃতীয় নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন বেশ বিতর্কিত । ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান হলেও পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী অনেক কাজ তিনি করেছেন । এ দেশের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক তা তিনি চাননি । ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে মিছিলের উপর গুলি চালানো হয় এবং সেই গুলিতেই রফিক, সফিক, সালাম বরকতসহ অনেকেই নিহত হন । খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন । পাকিস্তানের সামরিক শাসক আয়ুব খানের প্রিয়পাত্র হওয়ার কারণেই পূর্ববাংলার দুই প্রিয় নেতার পাশে অপ্রিয় এই বাঙালি নেতাকেও দাফন করা হয় ।
আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝামাঝি । আমার সামনে লেকের ওপারে সুউচ্চ ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ । স্বাধীনতা স্তম্ভের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি । সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বুকের মাঝে মনোরম লেক বেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ । আমি দূরদর্শী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করি । তিনি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের নামকরণ করেন তাঁর প্রিয়নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে । রেসকোর্স ময়দান হয়ে যায় ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ । সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বুকের মাঝে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ । অনুপম এক গুরুদক্ষিনা যেন ! এ যেন তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরুর স্বপ্ন পূরণের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত !
সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ । অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই আমার । আমি আয়েশি পায়ে রমনা বটমূলে এসে দাঁড়ায় । ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এখানে পহেলা বৈশাখে ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান করে । আসলে সেই মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখ পালন হয়ে আসছে । এইদিনে বৈশাখী মেলা, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, কুস্তি, হালখাতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে । কিন্তু আমাদের শিক্ষিত সমাজ গ্রামমুখী নয় । সাধারণ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত তাদের একটি বড় অংশ পাশ্চাত্যমুখী, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলামান হলে মক্কা -মদিনামুখী, হিন্দু হলে গয়া -কাশী মুখী। এ দেশে রোদবৃষ্টিতে ভিজে, কাদাজল ঘেঁটে যারা আমাদের আহারের ব্যবস্থা করে; সেই গ্রামবাংলার কৃষক- শ্রমিকমুখী আমরা নই । তাই যারা পহেলা বৈশাখে দেশে বা বিদেশে বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে এ দেশের গ্রামবাংলার মানুষের সাথে সেতুবন্ধন রচনা করেন- তাঁদের সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
আমি মিনটো রোড পার হয়েছি । আমার বাদিকে এ রোডের অভিজাত তিন নম্বর বাংলো । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সমবায় ও কৃষি উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বাংলোটি বরাদ্দ দেওয়া হয় । তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে এই সরকারি বাসভবনে উঠেন । তার দু’একদিন পরেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সাথে করাচী যেতে হয় । করাচী গিয়েই তাঁরা জানতে পারেন তাঁদের যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে । ফেরার পথেই তিনি জানতে পারেন তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে । সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই মিনটো রোডের এই বাংলোয় ফিরে আসেন তিনি । কিন্তু সেখানে আর থাকা হয়নি তাঁর । যুক্তফ্রন্ট সরকারের দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে একমাত্র তাঁকেই জেলে যেতে হয় । ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর সংসার করতে আসা মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে টুঙ্গিপাড়া ফিরে যেতে হয় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৬৭-২৭৩) ।
তারমানে ১৯৫৪ সালের জনগণের শতকরা ৯৭ ভাগ ভোটে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার সবাই পূর্ববাংলার নতুন গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার সাথে আপোষ করেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন আপোষ করেননি বলেই একমাত্র তাঁকেই জেলে যেতে হয় । মিনটো রোডের এই অভিজাত এলাকা তাঁকে ছাড়তে হয় । আর এই অভিজাত এলাকা তাঁকে ছাড়তে হয় এবং জেলে যেতে হয় বলেই, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এ দেশের সন্তান আমি ও আমরা এই অভিজাত এলাকায় থাকতে পারি । কিন্তু, শুধুই কি থাকার জন্যই এখানে থাকা ?
এই অভিজাত এলাকায় থাকা মানে কি এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ?
না । তা বোধহয় নয় ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ।