রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় রাশেদুল ইসলাম (তের)
প্রকাশ: ১১:০২ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বাঙালীর একটা বদনাম আছে । ‘বাঙালী একা একশ’ হতে পারে; কিন্তু একশ’ বাঙালী মিলে কখনও এক হতে পারে না’ । অভিযোগটা একেবারে অমূলক নয় । কারণ, বাঙালীর স্বভাব অনেকটা বটগাছের মত । বটগাছ যেমন তার নিচে অন্য কোন গাছ জন্মাতে দেয় না; একজন বাঙালীও যখন নিজে কোন না কোনভাবে বটগাছ হয়ে যায়, তখন সেও তার আশেপাশে আর কাউকে উঠতে দেয়না । তবে এর ব্যতিক্রম আছে । একশ’ বাঙালী এক হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও রয়েছে । আর একশ’ বাঙালী যখন এক হয়, তখন ‘বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়’ । কি অমিত তেজ ও শক্তি এই বাঙালী জাতির ! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের একটি । আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে । নত মস্তকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে । একুশের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ।
সত্যই, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন একটি বিস্ময়কর আন্দোলন । একটি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের শাসকগোষ্ঠী, যাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অর্জিত হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতা, সেই শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন । সত্যিই বিস্ময়কর ! ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টা হয় ১৮৫৭ সালে । তারপর পরবর্তী নব্বই বছরের ছোট বড় অনেক বিদ্রোহ, বহু দেশপ্রেমিক মানুষের আত্মদান এবং অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পার হয়ে অর্জিত হয় ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা । ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ পাকিস্তান নামক একটি নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম । কিন্তু একটি স্বাধীন মুসলিম দেশে ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন চেষ্টা নেই । পরাধীন দেশে যে বড়লাট ছিলেন সাদা চামড়ার বিলাতের একজন ইংরেজ; স্বাধীন দেশে সেই বড়লাট এখন গৌরবর্ণের একজন গুজরাটি পাকিস্তানি । বিলাতের ইংরেজ প্রায় দুশো বছরের শাসনকালে এদেশের সংস্কৃতিতে হাত দেয়নি । কিন্তু, পাকিস্তানের বড়লাট ছয় মাসের মধ্যেই এ দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চান । বাংলা মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চান । এই ঘোষণায় গর্জে ওঠে বাঙালী । একশ’ বাঙালী এক হয়ে যায় । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবীতে অকুতোভয় বাঙালী ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে । পুলিশের গুলিবর্ষণে সেদিন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে শহীদ হন । এসব শহীদের রক্ত যে কত শক্তিশালী অচিরেই তা টের পায় শাসক শ্রেণি । দেশব্যাপী গর্জে ওঠে সাধারণ মানুষ ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা দুদিনের মধ্যেই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ তৈরি করে। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু করে রাতের মধ্যেই তা শেষ করেন তাঁরা । সকলের নজর কাড়ে এই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ । দলে দলে লোক জড় হতে থাকে । দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’টি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন । সেদিন বিকালেই পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঘিরে ফেলে এবং স্মৃতিস্তম্ভ’টি ভেঙ্গে ফেলে । ঢাকা কলেজে একটি স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয় । পুলিশ ও সেনাবাহিনী সেটিও ভেঙ্গে ফেলে । কিন্তু শত বাঁধাবিপত্তি সত্ত্বেও দেশব্যাপী শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয় । ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে দেশব্যাপী ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয় । আধুনিক শহীদ মিনারের স্থপতি চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান । ১৯৫৭ সালে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় ।
২১ ফেব্রুয়ারি বা ‘শহীদ দিবস’ এর সুদূর প্রসারী প্রভাব লক্ষণীয় । একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে, তার মধ্যেই বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বীজ রোপিত হয় । ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সবই একই সুতোয় গাঁথা ।
এ ক্ষেত্রে আরও দু’টি বিষয় লক্ষণীয়ঃ
১) দেশ ও দশের কল্যাণে জীবন বিসর্জন যে মানুষের জীবনকে কত মহীয়ান করে, তার বাস্তব প্রমাণ একুশের শহীদগণ । প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু দেশে নয়, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ একুশের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে । যতদিন বাঙালি স্বত্বা পৃথিবীতে টিকে থাকবে, ততদিন এভাবে সবাই তাঁদের স্মরণ করবে । শুধু তাঁরা নন, তাঁদের উপর একটি গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ রচনার কারণে গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন । গানটির সুরকার আলতাপ মাহমুদ অমর হয়ে আছেন । ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস উদযাপনের আয়োজক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছে ।
২) শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরল সম্মান এনেছে একুশে ফেব্রুয়ারি; পৃথিবীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েছে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি । এক্ষেত্রে কয়েকজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভূমিকার কথাও না বললে নয় । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু শহীদ দিবস নয়; এটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩০ তম অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য পৃথিবীর ১৮৮ টি দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছে । ২০১০ সালে জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ পরিষদেও প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে । বাংলাদেশের একটি জাতীয় দিবসকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে । কিন্তু এই কৃতিত্বের দাবিদার কয়েকজন প্রবাসী বাঙালির । একজন সাধারণ মানুষের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা কিভাবে নিজের দেশকে সমুজ্জ্বল করে এটি তার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ।
কানাডায় বসবাসরত দুজন প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি পত্র লেখেন । পত্রে তাঁরা বাংলা মাতৃভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে এই দিনটি একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করেন । কফি আনানের অফিস থেকে এ বিষয়ে প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে যোগাযোগের জন্য বলা হয় । এরপর তাঁরা ইউনেস্কো সদর দপ্তরে আবেদন করেন । এ প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আনা মারিয়া একটি পত্রে ইউনেস্কো পরিচালনা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রস্তাবটি প্রেরনের পরামর্শ দেন । জনাব রফিকুল ইসালাম বিষয়টি বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানান । শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করে । সময় স্বল্পতার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে সরাসরি ইউনেস্কো সদর দপ্তরে প্রস্তাব প্রেরণের নির্দেশ দেন ।
ইউনেস্কো সদর দপ্তর প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিষয়ে দুটি সমস্যার উল্লেখ করেন –
(১) প্রতিবছর ১ লক্ষ ডলারের আর্থিক সংশ্লেষ এবং (২) নামকরণ ।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের ইউনেস্কো নির্বাহী পরিষদের ১৪৫ তম অধিবেশন এবং ৩০ তম সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী জনাব এ এস এইচকে সাদেক । তিনি তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতায় উপস্থিত সকলকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই ঘোষণায় জাতিসংঘের কোন আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে না । কারণ মাতৃভাষার প্রতি সকলের আন্তরিক ভালোবাসা আছে । তাই, অন্তরের ভালোবাসা দিয়েই নিজেদের খরচে সব দেশ দিবসটি পালন করবে । তারিখ নির্ধারণ বিষয়ে কোন কোন দেশ থেকে প্রশ্ন তোলা হলে, তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের মনের আকুলতা তুলে ধরেণ এবং এ বিষয়ে সকলের সম্মতি লাভে সমর্থ হন (ডঃ মোহাম্মদ হান্নান, ১৯৯৯) ।
অমর একুশের শহীদ দিবসকে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ব্যবস্থা গ্রহনে কানাডা প্রবাসী জনাব রফিকুল ইসলামসহ দেশে বিদেশে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন – তাঁদের সকলের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ।
(চলবে )
ইস্কাটন, ঢাকা, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ।