রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (বার)
প্রকাশ: ০৯:৫১ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:২২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
আমি এখন টিএসসির সামনে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- ছাত্র কেন্দ্র । ইংরেজ আমলের ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । টিএসসি ভবন তৈরি হয় অবশ্য অনেক পরে । স্বাধীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের শাসন আমলে । গ্রীক স্থাপত্য ধাঁচের এই অনিন্দ্য সুন্দর ভবনটি নির্মি্ত হয় ১৯৬১ সালে । শুধু একাডেমিক পড়াশুনা নয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেন বিভিন্ন বিষয়ে মুক্তচিন্তা বিকাশের সুযোগ পান, এজন্যই টিএসসি ভবন তৈরি । ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে পূর্ববাংলায় যে অসন্তোষ দেখা দেয়, ইংরেজ সরকার তা প্রশমনের ব্যবস্থা নেয় । সে সময়ে গঠিত স্যার রবার্ট নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে চমৎকার একটি রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিবেচনা করেন । ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলার গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য লর্ড রিপন তাঁর সমাবর্তন বক্তব্যে সেই কথাটিই সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন (ইমতিয়াজ আহমেদ ও ইফতেখার ইকবাল)। কিন্তু, এ কথা দিয়ে কি বুঝাতে চেয়েছেন লর্ড রিপন ?
ইংরেজ তার সাম্রাজ্য বিস্তারে হেন কোন নোংরা ষড়যন্ত্র ও অপকর্ম নেই, যা করেনি । কিন্তু এই জাতির একটি বিরল গুণ, স্বাধীন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন । যে শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা নিজেরা চার্চের শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে, কুসংস্কারের অচলায়তন ভেঙ্গে প্রগতির পথে এগুতে পেরেছে । নিজেদের কলোনি রাজ্যেও সেই একই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদারতাও তারা দেখিয়েছে । পূর্ববাংলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টিও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে সম্পূর্ণ আবাসিক হিসাবে গড়তে চেয়েছে তারা । তাইত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড । কিন্তু এই মুক্তচিন্তা বিকাশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে কিসের ইংগিত দেন লর্ড রিপন ?
প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত অঞ্চল এই পূর্ববাংলা । মোগল আমলের সুখী সমৃদ্ধ পূর্ববাংলা ব্রিটিশ শাসন আমলে দুঃখী বাংলায় পরিণত হয় । ইংরজের দ্বৈত শাসন নীতি এর বড় কারণ । ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এই অসমতা দূর করার চেষ্টা করা হলেও, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার ফলে ব্রিটিশের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। লর্ড রিপনের কথার ইঙ্গিতে এটাই প্রকাশ পায় যে, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই পারবে এই পিছিয়ে পড়া বাঙালি জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ।
লর্ড রিপনের কথার সত্যতা মেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে । ততদিনে বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে । পরাক্রমশালী ইংরেজ বিদায় নিয়েছে । দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়েছে । সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ পাকিস্তানের বড়লাট হয়েছেন কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ । পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি আল্লামা ইকবালের স্বপ্নের রাষ্ট্রে পূর্ববাংলার উল্লেখ না থাকলেও, তুখোড় যুক্তিবাদি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর অকাট্য যুক্তি দিয়ে ১৩ শ’ মাইল দূরবর্তী পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেছেন । পূর্ববাংলার নাম হয়েছে পূর্বপাকিস্তান । এই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারবলে আচার্য পাকিস্তানের বড়লাট কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ । ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন পাকিস্তানের বড়লাট এবং এদেশের ধর্মভীরু মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নেতা হিসেবে তাঁর প্রথম ঢাকা আগমন । সেদিন ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে কায়েদে আযম যা বলেন, একই কথা তিনি বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে । তিনি বলেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ । বড়লাট জিন্নাহর এই ঘোষণা এদেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয় । মুক্তচিন্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ততদিনে দুঃখী বাংলার মানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে । মুক্তচিন্তা দিয়েই ছাত্রছাত্রীরা বুঝে নেয়- (১) যে ইসলামের ধোঁয়া তুলে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছে, তা সাজানো মিথ্যা এবং (২) পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ইংরেজ থেকেও খারাপ; কারণ তারা বাঙালী মায়ের মুখের ভাষাও কেড়ে নিতে চায় ।
এখানে উল্লেখ্য যে, তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন । পূর্ববাংলার মানুষের কাছে শেখ মুজিব পূর্ব থেকেই অতি পরিচিত নাম । কারণ কোলকাতায় মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্ত সহচর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি । শাসক মহলে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সোহরাওয়ার্দী ভীতি ছিল । শেখ মুজিব ঢাকায় আসা মানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যে কোন সময় ঢাকায় আসার সম্ভাবনা । পূর্ববাংলার মানুষের কাছে সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা এবং একই সাথে তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা খাজা নাজিমুদ্দিনের ভয়ের মূল কারণ । ফলে ঢাকা আগমনের শুরু থেকেই জনপ্রিয় তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতে হয় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) । কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় অতিঅল্প সময়ের মধ্যে নিজের আসন করে নেন । ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন তিনি । তবে, ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনের অভিযোগে তাঁর উপর আরোপিত জরিমানা ও মুচলেকা দিতে অস্বীকার করাই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয় । কিন্তু তা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর কখনও কোন দূরত্ব তৈরি হয়নি । বরং বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু সম্পর্ক ছিল । ১৯৭২ সালের ৬ মে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বটতলায় সম্বর্ধনা দেওয়া হয় । ১৯৭৫ সালে তিনি যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তখন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা দেওয়ার দিন ধার্য ছিল । কিন্তু সেদিনই তিনি কতিপয় উচ্চাভিলাসী সামরিক অফিসারের নৃশংস হামলায় সপরিবারে নিহত হন । মহান আল্লাহ সেদিনের হামলায় নিহত বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহিদের বেহেশত নসিব করুন । আমিন ।
প্রকৃতপক্ষে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনুভূতি ও আকাংখার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক রাজনীতি একই সুরে বাঁধা ছিল’ ... সমগ্র জনগণের কালগত চেতনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে দানা বাঁধতে থাকে’ । ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতের আন্দোলনরত ছাত্রদের জীবন বিসর্জন - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহিদ মিনার তৈরি ও বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রাখে । ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয় । ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারাই ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করেন । ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের লাল - সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয় (ফখরুল আলম ২০১৭) । একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরণের সরাসরি প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকার উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল । তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এই প্রত্যক্ষ ভুমিকার কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে অপারেশন সার্চলাইটের তাণ্ডবলীলা চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় । স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দু’দিন আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রথিতযশা শিক্ষককে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকার নবাব স্যার খাজা সমিমুল্লাহ ৬ শ’ একর জমি দান করেন । কিন্তু এক পর্যায়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আয়তন দাঁড়ায় ২৬০.৬ একর । বর্তমানে এই পরিমাণ মাত্র ২৬.৬ একর । ১৯২১ সালে মাত্র ৮৭৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩০ হাজারের অধিক । অন্যদিকে বলা হচ্ছে, ‘১৯৭১ সালের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সব জাতীয় সংকটের মুখে উঠে দাঁড়িয়েছে তাদের ‘ন্যায্যতার নৈতিক মানদণ্ড’ নিয়ে । কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি ‘সংশ্লিষ্টতা’ ছিল তাদের ভাবনারও বাইরে । কিন্তু তাদের ‘নৈতিক মানদণ্ড’ আজ হারিয়ে গেছে’ (আবদুল মমিন চৌধুরী ২০১৭) ।
ফলে অনেকগুলো বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে জন্মশতবর্ষ পালন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । তবে সমস্যা থাকলে, তার সমাধানও থাকে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরনো ঐতিহ্য সমুন্নত রাখবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।
(চলবে)
ইস্কাটন, ঢাকা । ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ।