মোঃ শফিকুল আলম
“এটি গনতন্ত্রের সময় এবং দিন শেষে গনতন্ত্রই বিরাজমান রয়েছে।”
প্রকাশ: ১২:৫০ পিএম, ২৩ জানুয়ারী,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
জো বাইডেন সকল অনিশ্চয়তা দূর করে আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। জো বাইডেন তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে আমেরিকার কমাণ্ডার-ইন-চীফ হিসেবে ঘোষনা করে বললেন ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির কোলাহলপূর্ণ চার বছর মেয়াদ শেষে গনতন্ত্র বিজয়ী এবং বিরাজমান। কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প সাপোর্টারদের বর্বরোচিত আক্রমনের দু’সপ্তাহের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে জো বাইডেন অভিষিক্ত হলেন।
জো বাইডেন বললেন, “আজকের দিনটি আমেরিকানদের এবং গনতন্ত্রের।” “আজকের দিন হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকানদের প্রত্যাশার নবায়ন এবং বিভাজন নিরসন।” “আমরা আবার শিখলাম গনতন্ত্র যেমন অপরিহার্য এবং মূল্যবান তেমন সহজেই অপব্যবহারযোগ্য; কিন্তু গনতন্ত্রই বিজয়ী হয়েছে।”
জো বাইডেনের অভিষেকের পর পরই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা’ এক লাইনে বললে বাইডেনই হচ্ছেন বিভক্ত আমেরিকায় এই মুহূর্তে পরিবর্তন আনায়নে উপযুক্ত এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক। আমেরিকানরা অনেকটা রাজনৈতিক বিবাদ এবং বিভক্তিতে গত চার বছরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমেরিকা একটি বিশাল দেশ যার জন্ম হয়েছিলো বৈপ্লবিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এখনও চোখ বুলালে ভয়াবহ সিভিল ওয়ারের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যাবে। মজার ব্যাপার হলো আমেরিকা গত ৫০ বছর যে রাষ্ট্রসমূহকে হুমকি মনে করে যেমন, রাশিয়া এবং চায়না তাদের ইতিহাসও একই রকম। উল্লেখিত দু’টি দেশে বৈপ্লবিক যুদ্ধ একইভাবে নৃশংস সিভিল ওয়ার অনুসরন করেছিলো। কিন্তু আমেরিকা এবং উল্লেখিত দু’টি দেশের সামাজিক অস্থিরতা একই পথ অনুসরন করে নিয়ন্ত্রন করা হয়নি।
রাশিয়া এবং চীনে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিলো বিধায় সামাজিক অবকাঠামো মজবুত ভিত পায়নি। তাই এ দু’টি দেশে এখনও এক দলীয় ডিক্টেরশীপ বজায় রেখে, জনগনকে ভীতি এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করে রাষ্ট্রিক শান্তি বজায় রাখতে হচ্ছে। এখানে বাক স্বাধীনতা নেই, আন্দোলনের স্বাধীনতা নেই। অবাধ নির্বাচন এখানে রহস্যাবৃত। বিচার ব্যবস্থা এখানে আইনের শাসনের ব্যতিক্রম।
সমগ্র বিশ্ব দু’সপ্তাহ পূর্বে যখন আমেরিকাকে নিয়ে উদ্বেগে গুন্জরিত ছিলো ঠিক তখনই গনতন্ত্রিক বিধিই সকল উদ্বেগের সমাপন করে জো বাইডেনকে ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করলো। গনতন্ত্রই বলে দিলো এই মুহূর্তে জো বাইডেনই হচ্ছেন আমেরিকার ক্ষত শুঁকোতে সঠিক ব্যক্তি।
কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের আক্রমনের সময় বাইডেনের শান্ত কিন্তু দৃঢ় প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে লীডারশীপ যেটা আমেরিকার জনগন পছন্দ করে। অন্তত: এই মুহূর্তে আমেরিকার জন্য জো বাইডেনকেই প্রয়োজন। জো বাইডেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রায় ৫০ বছর কাটিয়েছেন ওয়াশিংটনে। সিনেটর এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি অনেক বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ সঙ্কট দেখেছেন এবং মোকাবেলায় অংশগ্রহন করেছেন। গত ৩০ বছরে আমেরিকায় যতো প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন তাঁদের সবার থেকে অভিজ্ঞতা সন্চায়নে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
জো বাইডেন জানেন একটি ভালো শাসন ব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়নে কতোটা কার্যকর। কংগ্রেস সদস্যগনের প্রত্যেকের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা নিয়ে ব্যস্ততা থাকে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় পার্টিতে অবস্থান ধরে রাখার বিষয় রয়েছে। সুতরাং জো বাইডেন জানেন কখন কংগ্রেস সদস্যদের ওপর নির্ভরতা এবং তাঁদের বিচার্যতা প্রয়োজন হবে। এবং তাঁদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিতে হবে দেশের স্বার্থে আইনি কাঠামোর মধ্যে বা আইন প্রনয়ন করে। দু’টি পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সমন্বয় করে কাজ করার তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে। রিপাবলিকান সিনেট লীডার মিচ ম্যাককোনেলের সাথে বাইডেনের সম্পর্ক অনেক গভীরে এবং পারষ্পরিক মর্যাদাপূর্ণ। এবং মিচের সাথে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই সম্পর্ক ছিলোনা।
একইভাবে জো বাইডেন ইতোমধ্যে যাঁদের কেবিনেটে নিয়োগ দিয়েছেন তাঁরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা সম্পন্ন। এঁদের প্রত্যেকের অর্থনৈতিক এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত সেক্রেটারী অব স্টেট টনি ব্লিনকেন ওবামা প্রশাসনে উচ্চ মেধাসম্পন্ন একজন অফিসিয়াল হিসেবে পরিগনিত ছিলেন। সেক্রেটারী অব ট্রেজারী জেনেট ইয়েলেন একজন ব্যতক্রমধর্মী স্মার্ট মানুষ। তিনি যেমন মাটির মানুষ হিসেবে পরিচিত তেমন সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন। এমন একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ অর্থনীতিতে গতিধারা আনায়নে সফল হবেন বলেই সবাই মনে করেন। এললয়েড অস্টিন একজন সাবেক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা ডিফেন্স সেক্রেটারী হিসেবে অবশ্যই সফলতার সাথে কাজ করতে সক্ষম হবেন। কেবিনেটে নিয়োগপ্রাপ্ত অন্যান্যদের ক্ষেত্রে জো বাইডেনের একই বিবেচনা অর্থাৎ অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা, মানবিকতা ইত্যাদি কাজ করেছে। বাইডেন যেমন রক্ষণশীল নন তেমনি চরম মৌলবাদী চরিত্রেরও নন। তিনি একজন উদারনৈতিক মানুষ। সুতরাং তাঁর গৃহীত নীতিসমূহ উদারনৈতিক হবে বলেই সবাই প্রত্যাশা করছেন। বাইডেন যেমন গনতান্ত্রিক তেমনই বাস্তবতা সচেতন। বাইডেন অর্থনীতিতে গতি সন্চারনে এবং কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করবেন বলেছেন। ভাইরাস পুরো আমেরিকাকে বিদ্ধস্ত করে ফেলেছে। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্দেশে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা বাইডেনের সুচিন্তিত পদক্ষেপে এবছরের মধ্যভাগে আমেরিকা স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে। ট্রাম্প নিজেকে ফিসকেল কনজার্ভেটিভ ( আয়করের হার কম রাখা, সরকারী ব্যয় সীমিত রাখার পলিসি) বললেও তিনি রাজস্ব আয়ের হিসাব থেকে দূরে ছিলেন এবং ব্যয়ের ব্যাপারে মোটেই সংযত ছিলেননা। আধুনিক ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্যানডেমিকের আঘাত আসার আগেই সবচাইতে বড় ঘাটতি বাজেট দিয়েছিলেন।
অবশ্য বাইডেনের নিয়ন্ত্রন কৌশল তাঁর নিজ দলের চিহ্নিত প্রগতিশীল অংশের চাপের সম্মুখীন হতে পারে। যদি তিনি তাঁদের চাপ সামলাতে পারেন তবে আমেরিকার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (GDP growth rate) হারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বোঝাই যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা চিরাচরিত হবেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থায় পূনরায় যোগ দিবেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনকে শক্তিশালী করবেন এবং মিত্রদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্টতর করবেন। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক তাঁর সাপোর্ট পাবে।
বিশেষ করে আমেরিকা বাকী বিশ্বের কাছে অনেকটাই বোধগম্য হবে। ট্রাম্প প্রশাসন পুরো সময়টা আনপ্রেডিক্টাবল ছিলো।
মোদ্দাকথা বাইডেন হবেন একজন সহানুভূতিশীল প্রেসিডেন্ট। তিনি যে সমস্ত দেশের পাশে দাঁড়ানোর বা আলিঙ্গন করার প্রয়োজন হবে তিনি তাদের আলিঙ্গন করবেন। তিনি সংবাদের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখবেন। তিনি কারও মতামত প্রকাশে বাঁধা হবেননা। তাঁর দ্বারা কেউ তাচ্ছিল্যের শিকার হবেননা বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হবেননা। বিশ্বকে নিশ্চয়ই প্রতিদিন সকালে উঠে টুইটারে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কি কি নেতিবাচক মন্তব্য রয়েছে তা’ আর পড়তে হবেনা।
কিন্তু বাইডেন এবং তাঁর টীমকে সতর্ক থাকতে হবে তাঁদের প্রথম মেয়াদের প্রথম দু’বছরের মধ্যে কংগ্রেসের যে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেই দিকে। এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারনা বলতে গেলে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকায় ব্লু-কালার (blue-collar) ভোটার হিসেবে চিহ্নিত মধ্য-পশ্চিমান্চলের ( Michigan, Ohio, Wisconsin, Minnesota, Illinois, Indiana and Kentucky)মানুষজন যারা রিপাবলিকান ভোটার। মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই ভোটারদেরকে তাদের দিকে নিয়ে আসা। নিউইয়র্ক এবং কেলিফোর্নিয়ার বাইরে বাইডেনের থেকে ট্রাম্প বেশি ভোট পেয়েছেন। বাইডেনকে আরও মনোনিবেশ করতে হবে খেঁটে খাওয়া মানুষদের স্টেটসমূহ যেমন পেন্সিলভানিয়া, মিশিগান এবং উইনসকনসিনে। বাইডেন জর্জিয়াতে জিতে প্রমান করেছেন যে তিনি পারেন। ৭৪ মিলিয়ন জনগন ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে যাদের জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতির তেমন কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করেই ট্রাম্প চার বছরে ১০ মিলিয়ন ভোট বৃদ্ধি করেছেন।
বাইডেন এই সমস্ত ভোটারদেরকে ফিরিয়ে আনায়নে সক্ষম।
অধিকাংশ আমেরিকান একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত। বাইডেনের শান্ত অথচ দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং অভিজ্ঞতা এবং ট্রাম্পের করুন বিদায় গনতন্ত্রের ক্ষত বুননে শক্তিশালী সুতোর জন্ম দিয়েছে। এবং আমেরিকানদের স্বাপ্নিক আমেরিকা জো বাইডেনই তৈরী করতে পারবেন। বিশ্বে গনতন্ত্র এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাক্।