মোঃ শফিকুল আলম
বর্তমান বা তথাকথিত আধুনিক রাজনীতি কি আধুনিক?
প্রকাশ: ১০:৩৭ পিএম, ১৩ জানুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৫৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
গত শতাব্দী ধরে আমরা গনতন্ত্রের নানান ধাপ প্রবাহমান দেখছি। এরই মধ্যে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন ছিলো। দক্ষিন ইউরোপে ফ্রাংকো এবং সালাজারের স্বৈর শাসন ছিলো। অবশান হতে দেখা গেছে গ্রীক সামরিক জান্তার শাসন।
অনিবার্যভাবেই বিশ্ব রাজনীতিতে গনতন্ত্রের বিজয়। গত শতাব্দীতে বিশ্ব লক্ষ্য করেছে ইউএসএসআর এর বিচ্ছিন্নতা, ল্যাটিন আমেরিকায় পিনোচেট এবং ভিদেলার স্বৈর শাসনের পতন। ফলত: আফ্রিকার বেশ কিছু অন্চলে গনতন্ত্রের বিস্তার। শতাব্দীর অগ্রসরতায় গনতন্ত্রের ভবিষ্যত অনেক আশার জন্ম দেয়। চলোমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ হয়তো অতীতের ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচারের অবশান করত: ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে।
প্রগতিশীলতা অপ্রতিরোধ্য। থামেনা বা থামানো যায়না। বিভিন্ন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ততা ঘটে। গতি রোধের চেষ্টা হয়। সমাজে অসমতা থেকে যায় নিদারুনভাবে। অর্থনৈতিক সংকট, ভয়াবহ সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি ইত্যাদি অনেকগুলো কারনের কয়েকটি আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবনে অব্যাহতভাবে অন্যায্যতা এবং বিচারহীনতা তৈরী করে চলছে। অনেকটা অপ্রতিরোধ্যতা লাভ করেছে।
এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। ভোটার বা নির্বাচকগন তাদের অংগুলির টিপে অনেক তথ্য পেতে পারেন এবং পেয়ে থাকেন। গন মাধ্যম তাদের হাতের মুঠোয়। তারা সব দেখেন এবং শোনেন। তাই নির্বাচকদের কাছ থেকে রাজনীতিকগন বর্ধিত হারে তাদেরকে শোনার, জানার এবং সম্মান প্রদর্শনের প্রতিনিয়ত চাপ অনুভব করছেন।
ইন্টারনেট এবং আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতায় মানুষের মধ্যে মুক্তির প্রত্যাশায় নতুন সূর্যের উদয়ন ঘটেছে। অকস্মাত মানুষ দেখতে পেলো মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে অতি সহজেই একে অপরের সাথে সংযুক্ত হতে পারছে। এবং সাধারন মানুষ সহজেই বিশ্ব রাজনীতির অন্ধকার অংশে মুহূর্তের মধ্যে সুইচ টিপে আলোর প্রজ্জ্বলন ঘটিয়ে সবকিছু দেখতে পায়। সবকিছু ফকফকা। যদিও আহাম্মক রাজনীতিকগন চোখ বন্ধ করে মনে করেন কেউ কিছু দেখেনি বা বুঝেনি।
ইন্টারনেটের যুগেও দ্বান্দ্বিকতা তৈরী হয়েছে। সব পরিবর্তনেরই বৈপরীত্য রয়েছে। নেতিবাচকতা রয়েছে। পূর্বের সকল সময়ের থেকে আধুনিক প্রযুক্তি নাগরিকদের অধিকতর জানার এবং জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু জীবন নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যাচ্ছে। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয় জীবন সব ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রন কঠিনতর হচ্ছে। ব্যক্তি তার নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছে। সবকিছু মনে হচ্ছে তথ্যসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তথ্য এবং ভুল তথ্যের দ্বন্দ্বে মানুষ, রাষ্ট্র এবং রাজনীতিক নিয়ন্ত্রনহীন।
অবাধ তথ্যের সরবরাহ থাকায় দেশে দেশে ভোটারগন আর পূর্বের স্টাইলে রাজনীতিকগনের নিয়ন্ত্রনে নেই। ভোটারদের কাছে সব তথ্য রয়েছে। সুতরাং এখন সেই রাজনীতিক প্রয়োজন যারা আধুনিক জটিল সময়ে তথ্যসমৃদ্ধ ভোটারদেরকে পরিচালনায় সক্ষম। সেই রাজনীতিক যারা সমাজের সামনে স্থির টার্গেট স্থাপন করে সমাজকে নির্দিষ্ট টার্গেট অর্জনপূর্বক স্থিতাতাবস্থায় ফিরিয়ে আনায়নে সক্ষম।
এমতাবস্থায় জনগন এবং রাজনীতিকগনের মধ্যে একটি অস্থিরতার সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে।
কিন্তু রাজনীতিকদের মনে রাখতে হবে এই তথ্যসমৃদ্ধ জনগনকে নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে পুরনো স্বৈরাচারের পথ অবলম্বন করা মানে নিজেদের কবর রচনা করা। বুটের তলায় সাধারন মানুষকে পিষ্ঠ করা আর সম্ভব হবেনা।
যদি আধুনিক রাজনীতিকগন শান্তিপূর্ণ গনতান্ত্রিক শাসন বজায় রাখতে চান তবে জনগনের সাথে সরাসরি মতবনিময় পূর্বক সেতুবন্ধন রচনা করতে হবে। ভোটার এবং রাজনীতিকের মধ্যে তথ্য এবং ভুল তথ্যগত সমস্যার সমাধান হবে। পরিবর্তন আনায়ন করতে হবে নেতার সাথে নাগরিকের ইন্টারএ্যাকশনের ক্ষেত্রে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ বহু দেশে এই ট্রানজিশন পিরিয়ডে রাজনীতিকগন অত্যন্ত পুরাতন পদ্ধতি ব্যবহারে উত্তরনের ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহারে নাগরিকের আস্থা অর্জন পুরোপুরি অসম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘ এক যুগের উন্নয়নের শ্লোগান নাগরিকের আস্থা অর্জনে সমর্থ্য হয়নি বিধায় দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করতে হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য পুরনো ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতে হচ্ছে।
নেতৃত্ব অনিশ্চয়তা ফেইস করতে চাননা বা ভয় পান। ক্ষমতার পতন একেবারেই চাননা। কারন, ভয়াবহ পরিনতি ভোগ করতে হবে। এই পুরনো ধ্যান ধারনার নেতৃত্ব মিথ্যা স্বপ্ন দেখানোতে ব্যস্ত। আগেই বলেছি সব তথ্য সবার কাছে রয়েছে। একটা কঠিন নেতৃত্বের চেহারায় পুরনো কায়দায় স্তাবক বেস্টিত অসার অবয়ব দিন শেষে রক্ষা দিবেনা। এই ধরনের নেতৃত্ব অপজিশনকে দূর্বল এবং অযোগ্য ভাবতে বা প্রমান করতে ব্যস্ত থাকে।
কোর সাপোর্টারদেরকে সংহত করতে হবে, সিদ্ধান্তহীনদের পক্ষে টানতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকা দু’টোই দীর্ঘ সময়ের জন্য সংহত হবে।
বর্ধিত হারে পতন ঠেকানোর কৌশল বরং নিজ প্রান্তে হতাশার জন্ম দেয়। শুরু হয় একের পর এক গনতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর আক্রমন। অবশেষে ক্ষমতা যেমন রক্ষা করা যায়না; দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা বলে জনগনের সাথে টেকসই সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তাদের মতামতের ওপর সম্মান প্রদর্শন এবং গুরুত্বারোপ হচ্ছে এই কৌশলের মূল মন্ত্র।
মানুষের স্বায়ত্বশাসনকে সম্মান করতে হবে। মানুষকে তাদের ভিশন প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদেরকে সার্বক্ষণিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে রাখতে হবে। তাদেরটা জানতে হবে, শাসকদেরটা তাদেরকে জানাতে হবে। শাসকদের তৈরী ব্লুপ্রিন্ট নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং তাদেরকে তাদের ব্লুপ্রিন্ট তৈরীতে সম্পৃক্ত করতে হবে।
সংকট এবং কঠিন সমস্যা গোপন করে নয় বরং ওপেন করে নাগরিকের কাছে সমাধান চাইতে হবে। শাসকদের ভিশন এবং উচ্চাকাংখা বাস্তবায়নে গোয়ার্তুমী না করে নমনীয় হতে হবে।
তথ্যসমৃদ্ধ বর্তমান ভোটারদেরকে চিৎকার করে ভাষন দিয়ে গনতন্ত্র বোঝানো যাবেনা। বরং রাজনীতিকরাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে চলে যাবেন।
রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন এ্যাপ্রোচ নিতে পুরনো বস্তাপচা শ্লোগান বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব তৈরী করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদেরকেও ব্যক্তিগতভাবে গনতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সকল জনগনকে সমান ভাবতে হবে।