রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (এগার)
প্রকাশ: ১২:৩৫ পিএম, ১১ জানুয়ারী,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৫০ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে একটি জাতিকে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করতে পারে, একটা দেশের জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের নিয়ামক হতে পারে –তার বাস্তব উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে চালু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
ইংরেজ বাংলার স্বাধীন মুসলমান নবাবকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে । মুসলমান মুঘল সম্রাটকে পরাজিত করে একের পর এক রাজ্য দখল করে । ফলে মুসলমানরা ছিল ইংরেজ শাসনের মূল প্রতিপক্ষ । সংগত কারণেই ভারতে যে ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ (Divide and Rule) নীতি ইংরেজ অনুসরণ করে, তাতে সুবিধার দিকটি পায় হিন্দুরা । মুসলমানেরা শাসিত ও শোষিত হয় । এ সময়ে মুসলমান আলেম সমাজের ইংরেজ এবং আধুনিক শিক্ষা বিরোধী ফতোয়া মুসলমানদের অবস্থা আরও শোচনীয় করে । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে হিন্দু মুসলমানদের এই বৈষম্য দৃষ্টিকটু ভাবে ইংরেজদের চোখে পড়ে । তাই শুধু ব্রিটিশ শাসকের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নয়; পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্যই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের ঘোষণা দেন । ঢাকাকে করা হয় রাজধানী । কিন্তু কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের চাপ এবং সশস্ত্র বিপ্লবের কারণে ১৯১১ সালে সেই বঙ্গভঙ্গ আদেশ রদ করা হয় । তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে পূর্ববাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হলে প্রথমে ব্যঙ্গ এবং পরে তার তীব্র প্রতিবাদ করা হয় । ব্যঙ্গের কথা আগেই বলা হয়েছে । এখন প্রতিবাদের কথা বলা যেতে পারে।
কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিন শ্রেণির মানুষ বিরোধিতা করে বলে উল্লেখ করেছেনঃ-
১। কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী
২। পশ্চিম বাংলার মুসলমান, এবং
৩। পূর্ববাংলার মুসলমান
কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীগণ বিরোধিতা করবেন এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় । কিন্তু আমি অবাক হয়েছি পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিরোধিতার কথা জেনে । কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং রাজনিতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঘোর বিরোধিতা করেন । ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফর শেষে কোলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ডঃ রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করে তাঁর নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করেন । সাধারণ মানুষের চোখে এ ধরণের অনেক বড় মাপের মানুষেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন বিরোধিতা করেছিলেন ভাবতে বেশ কষ্ট হয় । এ বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন । তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় দুই বাংলার মুসলমানদের বিরোধিতা বিষয়ে কিছুকথা এখানে বলা যেতে পারে ।
কুলদা রায়ের বর্ণনা অনুযায়ী পশ্চিম বাংলার মুসলমানগণ এই কারণে বিরোধিতা করেন যে, পূর্ব বাংলার ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাদের কোন লাভ নেই । তাই, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেন । আর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের যুক্তি ছিল পূর্ব বাংলার ১০ হাজার মুসলমান ছেলেমেয়ের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পাশ । ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে বাংলার মুসলমানদের কোন লাভ হবে না ।
লক্ষণীয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করতে গিয়ে দুই বাংলার মুসলমানদের অদূরদর্শিতা এবং সংকীর্ণ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে । আর এর মূল কারণ ইসলাম ধর্ম বিষয়ে তাঁদের স্বচ্ছ জ্ঞান এবং আধুনিক শিক্ষার অভাব । নিজের মঙ্গল হবে না বলে অন্যের অমঙ্গল কামনা করা বা নিজের উন্নতি হয় না বলে, অন্যের উন্নতিতে বাঁধা দেওয়া ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা নয় ।
আসলে ইসলাম ধর্মের বিশালতা অনেক ব্যাপক । পবিত্র কোরআনের মর্ম অনুযায়ী একটি ‘কুন’ শব্দ দিয়েই মহান আল্লাহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন (সূরা বাকারা) । সবকিছু সৃষ্টি করেন নির্ধারিত ওজন ও অনুপাতে (সূরা কামার) । এই ভারসাম্য পূর্ণ পৃথিবী ও তাঁর সকল সৃষ্টি যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে (সূরা বাকারা) । পবিত্র কোরআন শুধু মুসলমানদের জন্য নয় । বরং পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য । এ কারণেই হযরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে ‘হে মুসলমান’ বা ‘হে মুমিন’ সম্বোধন করেননি; বলেছেন, ‘হে মানুষ তোমরা শোন’ । নবী করিম (সঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন সব মানুষের জন্য এক রহমত হিসেবে’ (সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সঃ), পৃষ্ঠা ৬৯৪) । কোরআনের মর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর যে কোন মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময়ে পাহাড় পরিমাণ পাপ নিয়ে হলেও ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে পারেন । মুসলমানগণ নিজেদের মধ্যে সৎকাজের প্রতিযোগিতা করবেন এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কাজ ও ইবাদতের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করবেন - এটাই ইসলাম ধর্মের বিধান । কিন্তু ভাষাগত কারণে শুধু সাধারণ মানুষ নয়; দুই বাংলার আলেমগণের একটা বড় অংশ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না; ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনেক বিষয় জানেন না বলে প্রতীয়মান হয় ।
কোরআন ও হাদিসের অর্থ না জানার কারণে ভারতের আলেম সমাজ সবচেয়ে বেশী বিপদে পড়েন ইংরেজ আমলে । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইংরেজ ছলে বলে কলে কৌশলে ব্রিটিশ রাজ্যের বিস্তার ঘটায় । তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটি কৌশল ছিল খ্রিস্টান মিশনারীদের ব্যবহার । প্রভু যীশু একটি আশ্রিত কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম নেন । এ কারণে সমাজের অনেক লাঞ্চনা গঞ্জনা তাঁরা পেয়েছেন । তাই, যীশুভক্ত মিশিনারিগন একটি দেশের নিম্নস্তরের অবহেলিত অতিদরিদ্র মানুষদের সেবার ব্রত নিয়ে আসেন । তাঁরা স্থানীয়দের মাতৃভাষা নিজেরা শিখেন এবং সেই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে ধর্মের মর্মবাণী প্রচার করেন ।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় উল্লেখ করেছেনঃ
“ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চাই দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা বয়ে যায়, খায়নিক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন” ।
এটা আর এক রুঢ় বাস্তবতা । সমাজে নিম্নস্তরের হতদরিদ্র মানুষের কোন সম্মান নেই । তিন বেলা খাবার জোটে না তাদের । সেই অবহেলিত শ্রেণির মানুষ যখন প্রভু যীশুখৃষ্টের ভালবাসার কথা শোনে, রুটি রোজগার সংস্থানের আশ্বাস পায়- তখন তারা দলে দলে ধর্মান্তরিত হতে থাকে । মাথায় বাজ পড়ে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মগুরুদের । তবে হিন্দু ধর্মগুরুদের সুবিধা ছিল । কারণ অনেক আগেই তাদের
ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুদিত হয়েছে । কিন্তু মুসলমান আলেমগণের বিপদ অনেক বেশী । কারণ, তারা নিজেরাও মাতৃভাষায় বুঝে ধর্ম শিক্ষা করেন নি । আবার বাংলায় অনুবাদ করা কোরআন হাদিস বাজারেও নেই । আর একটা সমস্যা এই যে, যীশু ঈশ্বরপুত্র- এই কথা বাদ দিলে বাইবেল এবং কোরআনের বাণী মূলত একই । এ ছাড়া আসমানি কিতাবে বিশ্বাস করা মুসলমানদের জন্য ফরয । কারণ, কলেমায় বলা হয়, ‘আমান্তুবিল্লাহ ওয়া মালাইকাতিহি, কুতুবিহি... অর্থাৎ আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর ফেরেসতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি...। এখানে যে কিতাবগুলির কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে ইঞ্জিল বা বাইবেল একটি । আমাদের আলেমমগন এই সকল আসমানি কিতাব বিশ্বাস করার কথা উল্লেখ করলেও তাঁদের প্রায় সকলেই কখনও সেগুলো না পড়েই বিশ্বাস করার কথা বলেন ।
বাইবেল এবং কোরআনের বাণী যদি ভিন্ন হয়, তাহলে কোনদিক থেকে এবং কেন ভিন্ন -তা ব্যাখ্যা করার জন্য দুটি ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধেই জানা দরকার । কিন্তু ভারতের আলেমগণ অন্যান্য আসমানি কিতাব পরের কথা, নিজেদের ইসলামী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন বিষয়েই স্বচ্ছ ধারণার অভাবে মিশনারি পাদ্রিদের কোন কথার জবাব দিতে পারতেন না । এ কারণে তাঁরা অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন । মুসলিম আলেমগণের এ অবস্থা থেকে উদ্ধাদের জন্য এগিয়ে আসেন বহু ভাষাবিদ হিন্দু পণ্ডিত ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন । তিনি ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কোরআন অনুবাদের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন । প্রথম খণ্ডে তিনি মুসলমানদের ভয়ে নিজের নাম প্রকাশে বিরত থাকেন । পরে মুসলমান আলেমদের অনুরোধেই তিনি স্বনামে ১৮৮৬ সালে কোরআনের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন । কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এখনও আলেম সমাজের একটি বড় অংশ মাতৃভাষায় কোরআন প্রচার নিরুৎসাহিত করে থাকেন । তাঁরা বিদেশী ভাষা উর্দু এবং ফার্সিতে বয়ান করা অধিকতর ধর্মসম্মত মনে করলেও ধর্মশিক্ষায় নিজেদের মাতৃভাষা বাংলাকে মোটেও গুরুত্ব দিতে চান না। তাই, বর্তমান কালেও নামাজির সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মহান আল্লাহর কাছে তাঁরা কি ফরিয়াদ করেন বা ওয়াদা করেন তার অর্থ তাঁরা নিজেরা জানেন না ।
অনেক বিরোধিতার মুখেই ১৯২১ সালের ১লা জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় । জনাব তৈমুর আলম খন্দকার তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি বিতর্ক’ নামক প্রবন্ধে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর জমি, ধনবাড়ির জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী এবং ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া)’র অর্থ এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের রাজনৈতিক প্রভাব অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেছেন ।
আমি এই সুযোগে যারা পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে অবদান রেখেছেন, তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । মহান আল্লাহ তাঁদের সকলের আত্মার শান্তি নিশ্চিত করুন ।
করোনা মুক্ত নতুন বছর কামনা করি ।
সকলকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা ।
(চলবে)
১ জানুয়ারি, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।