রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (নয়)
প্রকাশ: ০৭:৪২ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ০২:২৯ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
পবিত্র কোরআন থেকে নিজে শিক্ষা নিয়ে ধর্মপালনের কথা কোরআনে বলা হয়নি । ধর্মপালনের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা রসুল যা করতে বলেন, তাই কর” (সূরা আনফাল) । বলা হয়েছে, “যে রসুলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করে” (সূরা নিসা, আয়াত ৮০)। নিজে কোরআন পড়ে তা বুঝে সে অনুযায়ী ধর্মপালন করার বিধান কোরআনে না থাকার নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণ রয়েছে । সেই কারণ মহান আল্লাহ নিজে এবং তাঁর রসূল ভালো জানেন । আলেমগনও তাঁদের মত ব্যাখ্যা দিতে পারেন । তবে, আমার সীমিত জ্ঞানে মনে হয়েছে এর দুটি কারণ-
১) পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর মত নিরক্ষর একজন নবীকে ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক বিষয়ের যাবতীয় জ্ঞান দিয়েছেন । সুদীর্ঘ ২৩ বছর যাবত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এই জ্ঞান তাঁকে এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যেন তিনি সবকিছুর অন্তর্নিহিত অর্থসহ বুঝতে পারেন এবং সে মোতাবেক করণীয় নির্ধারণ করতে পারেন । পবিত্র কোরআনে ইউসুফ জুলেখার কাহিনী যেমন আছে; লুত পয়গম্বরের জামানার সমকামী মানুষের কথাও আছে । নবীজির জানের শত্রু আবু লাহাবকে অভিশাপ দেওয়ার কথা যেমন আছে; আবাবিল পাখির সাথে হাতিবাহিনীর অসম যুদ্ধের কথাও আছে । এসবের মধ্য থেকে ধর্মপালনের জন্য একজন ব্যক্তিমানুষের করণীয় বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ মানুষের পক্ষে তো একেবারেই সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে কোরআনের একেক জনের ব্যাখ্যা একেক রকম হতে বাধ্য । এসব সমস্যা নিরসনের জন্যই পবিত্র কোরআনে ধর্মপালনের ক্ষেত্রে একমাত্র নবী করিম (সঃ) কেই অনুসরণ করতে বলা হয়েছে ।
২) পবিত্র কোরআনে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের সংঘবদ্ধ ভাবে বসবাস করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে (সূরা বালাদ) । এই সংঘবদ্ধ থাকার জন্যই সাপ্তাহিক জামাতে জুমার নামাজ, জামাতে দুই ঈদের নামাজ এবং বিশ্ব সংঘবদ্ধতার জন্য হজ্বের বিধান রাখা হয়েছে । পবিত্র কোরআন বিষয়ে একেক জন মানুষ একেক মত ও পথ অনুসরণ করলে মানুষ সংঘবদ্ধ না হয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে পারে; ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হতে পারে । মহানবী (সঃ) তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে মানুষকে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন । হয়ত এসব কারণেই পবিত্র কোরআনে বিশ্বাসীদের একমাত্র নবী করিম (সঃ)কেই কথা ও কাজে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
মা আয়েশা (রাঃ) এঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে পবিত্র কোরআনের প্রতিফলন রয়েছে । ফলে, হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর জীবনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করলেই ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানা সহজ হয় ।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর জীবনী থেকে আমরা জানি যে, তিনি একজন সত্যবাদী মানুষ ছিলেন । জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলেন নি । তিনি জীবনে কখনও কারো সমন্ধে গীবত করেন নি । সারাজীবন মানুষের উপকার করেছেন । কখনো কারো কোন প্রকার ক্ষতি করেন নি । কারো প্রতি কখনও কোন ঘৃণা, বিদ্বেষ বা ক্ষোভ পোষণ করেননি । প্রকৃতপক্ষে কোন অস্ত্র দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়েই তিনি মানুষকে জয় করেছেন । পৃথিবীকে জয় করেছেন । তিনি আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মহিমা দ্বারা মানুষকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন ।
সংগত কারণেই হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর ব্যক্তিজীবনের কথা ও কাজ অনুসরণ করলে পবিত্র কোরআনে বিশ্বাসীদের জন্য নির্দেশিত ৩ টি কাজঃ
১) মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা,
২) সৎকাজে অংশ নেওয়া এবং
৩) আল্লাহর ইবাদত করা
যথাযথভাবে সুসম্পন্ন হতে পারে এবং এগুলিই ইসলাম ধর্মে নির্দেশিত মৌলিক বিষয় ।
ধর্মের এই মৌলিক বিষয়গুলো খুব সহজভাবে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে । কিন্তু আমাদের আলেমগনের অনেকে আছেন যারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন । এর ৩টি কারণ হতে পারেঃ
১) কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাব,
২) আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের ধর্ম শিক্ষার প্রতি অবহেলা ।
৩) উদ্দেশ্যমূলক ।
আমাদের দেশে কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাবের মূল কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষা গ্রহন না করা । মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহন না করলে একজন মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে না । কিন্তু শুধু আমাদের দেশ নয়, এই উপমহাদেশের ধর্ম শিক্ষা মূলত মুখস্থ নির্ভর । বলা হয়ে থাকে ধর্ম সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ব্যাপার । ফলে অন্ধভাবে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলাই ধর্ম । কিন্তু পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে । কোরআনে বলা হয়েছে,
”আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জীব সেই মূক ও বধিররা, যারা তাদেরকে প্রদত্ত বিচারবুদ্ধির ব্যবহার করেনা (সূরা আনফাল, আয়াত ২২) ।
আর কোন কিছুর অর্থ না জানলে, একজন মানুষ নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে কিভাবে ? স্বয়ং আল্লাহ তাঁর নবীকে যথাযথভাবে কোরআন শিক্ষা দেবার জন্য নবীর মাতৃভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছেন । অথচ আমাদের আলেমগনের অনেকেই অজ্ঞতাবশত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এদেশের মানুষকে মাতৃভাষা বাংলায় অনুদিত হাদিস কোরআন পড়তে উৎসাহিত করেন না; বরং ইসলাম ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী মনে করেন ।
আমাদের দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অনেকেই ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা নেওয়া বা কথা বলাটা ‘খ্যাত’ মনে করেন । তাঁরা তাঁদের সবচেয়ে বোকাসোকা ছেলেমেয়েদের ধর্ম লাইনে পড়তে বলেন । ফলে তাঁরা নিজেরা যেমন ধর্ম সম্বন্ধে কিছু জানেন না; তাঁদের বোকাসোকা ছেলেমেয়েরাও মুখস্থ বিদ্যার কারণে ধর্ম বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না । আলেম সমাজের অনেকেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের এই দুর্বলতা জানেন । ফলে তাঁরা অবলীয়ায় ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন । আর এ সব কাজ এক শ্রেণির আলেমগণ বুঝে বা না বুঝে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই করে থাকেন ।
তবে সুখের কথা এই যে, এখন আলেমগনের মধ্যে সত্যিকার ইসলাম ধর্ম বিষয়ে আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন অনেক বুজুর্গ ব্যক্তি রয়েছেন এবং তা ক্রমবর্ধমান । তাঁদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে ধর্মের অপব্যাখ্যা দেওয়ার পরিমাণও কমে যাবে । ইনশাল্লাহ !
আমি বলছিলাম রমনা রেসকোর্স ময়দান – বা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের বড়লাট কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ দেওয়ার কথা । যে ভাষণে তিনি, ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন । বলছিলাম জিন্নাহর সেই ভাষণ এদেশের জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করলেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অনেক আলেম সে সময় মতামত দেন । তাঁরা জানান, ‘উর্দু ইসলামিক ভাষা’ । কিন্তু, তাঁদের এই বক্তব্য ছিল উদ্দেশ্যমূলক ।
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে । রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন রাজপথে প্রাণ দিতে হয় রফিক, শফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা অনেক সোনার ছেলেদের । লক্ষণীয় যে, তখন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঙালি সন্তান নুরুল আমিন । আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ঢাকা নবাব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন । এই খাজা নাজিমুদ্দিন ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজারের তিন নম্বর ব্যক্তি ।
খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে খাজা নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে বলেন, “১৯৪২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী (অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী) হয়ে নিজের ভাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন । আবার তাঁর বংশের থেকে এগার জনকে এমএলএ বানিয়েছিলেন ।“
বঙ্গবন্ধুর এই মন্তব্য থেকে খাজা নাজিমুদ্দিন সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় । খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা নবাব পরিবারের সন্তান ছিলেন । তবে তিনি নিজের নবাব পরিবার ছাড়া, এ দেশের সাধারণ কোন মানুষকে কখনও মানুষ মনে করেননি ।
(চলবে)
১৮ ডিসেম্বর, ২০২০ । ইস্কাটন, ঢাকা ।