রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (আট)
প্রকাশ: ০৬:২১ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ১২:৩১ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
শীতের প্রকোপ বেড়েছে । সকালের কুয়াশা অনেকটা কেটে গেছে । আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে । আমার সামনে শিখা চিরন্তন । একটি প্রজ্বলিত শিখা । ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসের ৭ তারিখে সেদিনের রমনা রেসকোর্স ময়দানের ঠিক এইখানে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হৃদয়ে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ঝড়তোলা সেই ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ । একই জায়গায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধজয়ী বাঙালি জাতির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয় । এ দুটি বিষয়কে বাঙালি মনে চিরজাগরূক রাখতেই আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই শিখা চিরন্তন । ১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ছুঁয়ে প্রজ্বলিত শিখা চিরন্তন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছায় ২৬ মার্চ, ১৯৯৭ । সেদিন বিশ্বনন্দিত চারনেতা এই শিখা চিরন্তন স্থাপন করেন । নেতারা হলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দক্ষিন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন মেনডেলা, ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সুলেমান ডেমিরেল এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
বাঙালি জাতির বিজয়ের গৌরবগাঁথা বুকে ধারণ করে আছে এই রমনা রেসকোর্স ময়দান – বা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান । এই রমনা রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়েই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত পাকিস্তানের বড়লাট কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ভাষণ দেন । সেই ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন , ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ । যে ভাষার নামে একটি জাতির নাম, যে ভাষার নামে একটি প্রদেশের নাম, একটি দেশের নাম, যে ভাষা একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা, তাদের মায়ের ভাষা, সেই ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না- রাষ্ট্রভাষা হবে ভিনদেশী একটি ভাষা ! এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের মুখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যান বাগ্মী নেতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ । আসলে স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যে প্রাণপ্রিয় নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আগমন এদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে । কিন্তু, তাঁর এই ঘোষণা দেশের সাধারণ মানুষের মনে শেলের মত বেঁধে ।
এ কথা সত্য যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজের মাতৃভাষা গুজরাটি বা উর্দু কোনটাই ভালো বলতে পারতেন না । পশ্চিমা জীবনধারায় অত্যন্ত বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইংরেজীতে পারদর্শী ছিলেন । তিনি তুখোড় রাজনীতিবিদ ছিলেন । তাঁর ক্ষুরধার ও শাণিত যুক্তির কাছে দাঁড়াবার মত সমসাময়িক কালে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না । হয়ত এ কারণেই নিজে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সুন্নী মুসলিম অধ্যুষিত অল ইনডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন । পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহনের জন্য তিনি ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট দিল্লি থেকে দলবলসহ করাচী চলে আসেন । স্বাধীনতা ঘোষণার তিন দিন আগে ১১ আগস্ট, ১৯৪৭ করাচীর ন্যাশনাল এস্মেব্লীর ভাষণে তিনি বলেন, ‘তোমরা এখন স্বাধীন । তোমরা এখন ইচ্ছেমত প্রার্থনার জন্য মন্দির, মসজিদ বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে কোন উপাসনালয়ে যেতে পার’ (You are free; you are free to go to your temples, you are free to go your mosques, or anyother place of worship in this state of Pakistan, (Wolpert, pp 337-339) । তারমানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান নামে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন । তাই যদি হয়, তাহলে ধর্মের নামে প্রাণঘাতী এই বিভাজন কেন ?
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ভারত পাকিস্তান ভাগ হয় । সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল স্যার র্যাডক্লিফের । কিন্তু লর্ড মাউনটব্যাটেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তিনি তাঁর ইচ্ছেমাফিক দুই দেশের সীমানা নির্ধারণে স্যার র্যাডক্লিফকে প্রভাবিত করেন । এই উদ্দেশ্যমূলক সীমানা নির্ধারণের কারণে দেশবিভাগের আগে ও পরে ভারত- পাকিস্তানের ১ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষের সাতপুরুষের ভিটেবাড়ি ছেড়ে যেতে হয় । হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একে অপরকে হত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মত মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে । স্যার র্যাডক্লিফের একান্ত সচিব তাঁর একটি লেখায় এসবের জন্য লর্ড মাউনটব্যাটেনকে দায়ী করেছেন (Lawson Alastair, 10 August, 2007) । স্যার র্যাডক্লিফ নিজে তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তিনি জানেন তাঁর এ কাজে কোন পক্ষ খুশী হবে না । তাই তিনি তাঁর কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নিতে রাজী হন নি (Khan, PP 124-127) । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতা গ্রহণকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দিলে, এধরণের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ ঘটত না বলে অনেকে মনে করেন ।
পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য । এদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কখনও বলতে পারতেন না যে, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । কিন্তু এটি অন্যায় প্রস্তাব হলেও এদেশের আলেম সমাজের একটি বড় অংশ এই প্রস্তাব মেনে নেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেন,”যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’ । উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না” (পৃষ্ঠা ৯৮) ।
আসলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ধর্ম বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না । তাঁদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এদেশের আলেম সমাজের একটি বড় অংশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মের নামে এমন সব ফতোয়া দিয়ে থাকেন, যা পবিত্র কোরআন হাদিসের সাথে মোটেও সম্পর্কিত নয় ।
যেমন, ‘উর্দু ইসলামিক ভাষা’ । আরও কিছু ফতোয়ার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে-
ইংরেজ আমলে তাঁরা ফতোয়া দেন, ‘ইংরেজি শিক্ষা হারাম’ ।
তাঁরা বলেন, ‘নারী শিক্ষা হারাম’ ।
অথচ, পবিত্র কোরআনের নাযিল হওয়া প্রথম শব্দ, ‘পড়’ । প্রথম বাক্য, ‘পড় তোমার আল্লাহর নামে’ ।
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নরনারীর জন্য বিদ্যার্জন করা ফরয’ । অথচ, কতিপয় আলেম ফতোয়া দিয়েছেন তাঁদের ইচ্ছেমত । ইসলাম ধর্মের বিধান মতে নয় ।
তাঁরা নারী নেতৃত্বকে হারাম বলেছেন । মেয়েদের চাকরি করা হারাম বলেছেন ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা বলেছেন,’যুদ্ধের সময় নারীধর্ষণ করা জায়েজ’। সকলেরই জানা, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দুই লক্ষাধিক মা- বোন পাক সেনাবাহিনী দ্বারা সম্ভ্রমহানির শিকার হন ।
উপমহাদেশে যখন প্রথম রেলগাড়ি চালু হয়, তখন তাঁরা বলেন নবী কখনও রেলগাড়ি চড়েননি, তাই মুসলমানদের জন্য রেলগাড়িতে চড়া হারাম ।
তাঁরা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নাস্তিক ঘোষণা দিয়েছেন । তাঁরা বলেছেন ছবি তোলা হারাম, মাইকে আজান দেওয়া হারাম, রেডিও হারাম, ক্যামেরা হারাম, টিভি দেখা হারাম, ভিডিও হারাম, নারীদের পুরুষ ডাক্তার দেখানো হারাম ইত্যাদি ইত্যাদি । লক্ষনীয় যে, এ পর্যন্ত তাঁরা যাকিছু হারাম বলেছেন, পরবর্তীতে তার সবগুলোই তাঁরা বৈধতা দিয়েছেন; নিজেরা সেগুলো গ্রহন করেছেন । তাহলে তাঁদের সমস্যা কোথায় ?
এখানে মূল সমস্যা হোল আমাদের এক শ্রেণির আলেমগণ এ পর্যন্ত যা কিছু হারাম বলেছেন বা এখনো বলছেন - সেগুলোর কোনটাই ইসলামের মৌলিক বিষয় নয় ।
তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসলামের মৌলিক বিষয় কি ?
এ প্রশ্নের জবাব আমাদের পবিত্র কোরআন থেকেই পেতে হবে ।
আমার জানামতে পবিত্র কোরআনে মানবসৃষ্টির তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে –
এক) আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা ( সূরা বাকারা, আয়াত ৩০)
দুই) মানুষ নিজেদের মধ্যে সৎকাজে কে বেশী এগিয়ে আছে, তা পরীক্ষা করার জন্য
(সূরা মূলক, আয়াত ২) ।
তিন) আল্লাহর ইবাদতের জন্য (সূরা জারিয়াত, আয়াত ৫৬)
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে মানুষের উদ্দেশে বলেন,
‘তোমাদের জন্য আমি দুটি জিনিষ রেখে গেলাম –
১) আল্লাহর কোরআন এবং ২) আমার জীবন দর্শন ।
তখনও পবিত্র কোরআন গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়নি । এ কারণে অনেক সাহাবী মা আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করেন, ‘কোরআন কি ?” । মা আয়েশা জবাব দেন,
“তোমরা কি তোমাদের নবীকে দেখ নাই ?”
তারমানে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর জীবনাচারের মধ্যে পবিত্র কোরআনের প্রতিফলন রয়েছে । এ কারণে পবিত্র কোরআনকে বলা হয় ‘পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান’ (Complete code of life) ।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা রসুল যা করতে বলেন তাই কর” (সূরা আনফাল) ।
অন্য একটি সুরায় বলা হয়েছে, “যে রসুলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করে” (সূরা নিসা, আয়াত ৮০)।
(চলবে )
১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ । ইস্কাটন, ঢাকা ।