রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (সাত)
প্রকাশ: ০৯:৩৩ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০১:৫৪ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ভারতে আমরা বিদেশী । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে বাংলদেশী যে কোন নাগরিক ভারতে বিদেশি । আগ্রার তাজমহল দেখতে গেলেও তাকে বিদেশী হিসাবে গন্য করা হয় এবং ভারতীয়দের থেকে অনেকগুণ বেশী প্রবেশমূল্য দিতে হয় । আমার জানামতে কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা সার্কভুক্ত দেশের অধিবাসী হিসাবে কিছু কমিশন পেয়ে থাকে । কিন্তু বাস্তবে মোঘল বা ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কোন স্থাপত্য দর্শনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের সমপর্যায়ে থাকার কথা নয় । অবিভক্ত মোঘল -ভারত বা ব্রিটিশ- ভারতে যে কোন স্থাপত্য নির্মাণে পূর্ববাংলার মানুষের ঘামে ঝরা অর্থের অংশীদারিত্ব রয়েছে । কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ তড়িঘড়ি করে ভারত না ছাড়লে, এসব যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করা যেত । সেক্ষেত্রে ভারতের তাজমহলসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসমুহ দর্শনে আজও বাংলাদেশী জনগণ ভারতীয়দের মত সমান সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল ।
‘শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) এঁর পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে ।‘ এরকম কথা হয়েছিল যে, ‘বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে । জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে । সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্থান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে । কিন্তু, ‘দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতাম না’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃষ্ঠা ৭৩, শেখ মুজিবুর রহমান)। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসব আলোচনার জন্যই কলকাতা অপেক্ষা করছিলেন । কিন্তু তাঁকে না জানিয়েই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের দলবল স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহনের জন্য ভারত ছেড়ে যান ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত তরুণ নেতারা তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দুটি দেশের গভর্নর জেনারেল হিসাবে চেয়েছিলেন (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫, শেখ মুজিবুর রহমান) । তাঁদের এই চাওয়ার একটা সুদূর প্রসারী লক্ষ্য ছিল । লর্ড মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল হলে দুটি দেশের যৌক্তিক সীমানা নির্ধারণ ও অন্যান্য দাবী পূরণ সহজ হত । ব্রিটিশ ভারতের মানুষ স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে শতবর্ষের অধিককাল যুদ্ধ করেছে সত্য । কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন যুদ্ধের মাধ্যমে হয়নি । ইতিপূর্বে অনেক প্রতিকুল অবস্থায় যুদ্ধ মোকাবেলা করেও ইংরেজ ভারত ছাড়েনি । প্রায় দুই শ’ বছর রাজত্ব করেছে । ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে কি এমন হোল যে, ইংরেজ ভারত ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠলো ? প্রকৃত সত্য এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আপাত দৃষ্টিতে হিটলারের অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটলেও, মূল পরাজয় ঘটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে কলোনি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ব্রিটিশের ছিল না । বীরের জাতি ইংরেজ তাই চেয়েছে সম্মানজনক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন । লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নর জেনারেল করা হলে একটা যৌক্তিক সমাধান আশা করা যেত । কিন্তু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর প্রস্তাব গ্রহন না করাই, তিনি ক্ষেপে যান । র্যাডক্লিফকে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হলেও প্রকৃতপক্ষে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ইচ্ছেমতই তা করা হয় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃষ্ঠা ৭৩, শেখ মুজিবুর রহমান) ।
‘...মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন । নদিয়ায় মুসলমান বেশী তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন । মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশী কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন । …বালুরঘাট মহাকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্থানে যায় … উপরোক্ত জায়গাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না ।‘ বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে দুঃখের সাথে বলেছেন, “যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা সেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম” ( পৃষ্ঠা ৭৮-৭৯) ।
এভাবে সীমানা নির্ধারণের কারণে দেশ বিভাগ নয়, অনেক পরিবারের অঙ্গ ভাগ হয়ে যায় । বাপমা একদেশে তো, ছেলেমেয়েরা আর এক দেশে । একান্নবর্তী পরিবারের এক অংশ এপারে, আর এক অংশ ওপারে । স্নেহ মমতা ভালবাসার টানে যখন তারা একে অপরের সাথে মিলিত হতে চেয়েছে, সীমান্তে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের অনেকের । বাংলা পাক ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন যে রক্তক্ষয় তা অনেকটা মাউন্টব্যাটেনের সেই ক্ষোভ প্রকাশের পরিণতি বলা যায় ।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত দুই ভাগে ভাগ হয় । মুসলমান জাতির জন্য পাকিস্তান; আর হিন্দু জাতির জন্য হিন্দুস্থান (ভারত) । কিন্তু মুসলমান রাষ্ট্রের মডেল কি হবে ? হিন্দু রাষ্ট্রের মডেলই বা কি হবে ? - সে সময় এ ধরণের প্রশ্ন তোলা হলে উভয় পক্ষই তাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করত ।
ভারত উপমহাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু । ধর্মের নামে তারা অকাতরে জীবন দিতে পারে । পূর্ববাংলার মানুষও তার ব্যতিক্রম নয় । অন্যদিকে ধর্মভীরু হলেও সাধারণ মানুষের ধর্ম বিষয়ে নিজেদের কোন পড়াশুনা নেই । তাই ধর্মীয় নেতারা ধর্মের যে ব্যাখ্যা দেয়, তাই তারা বিশ্বাস করে । এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই অনেকে নিজেদের ফায়দা লুটে নেয় । কলকাতার মুসলমান সম্প্রদায় অনেক সম্পদশালী ছিল । সুযোগ সন্ধানীরা দ্বিজাতি তত্ত্বের এমন ব্যাখ্যা দেয় যে, কলকাতা হিন্দুস্থান হবে, সেখানে কোন মুসলমান থাকতে পারবে না । মুসলমান তাড়ানো বা হত্যা করা হিন্দুদের জন্য পুণ্যের কাজ । একইভাবে এক শ্রেণির মোল্লারা সাধারণ মুসলমানদেরকেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে । যার পরিনিতিতে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও লুটপাট । অথচ উভয় ধর্ম বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হলে অন্তত পরের প্রজন্ম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে রক্ষা পেত ।
আলোচনা হলে মুসলমানরা তাদের কাম্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলত এবং তা হত হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর প্রদর্শিত পথ । কারণ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজে একটি রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন । তিনি যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, সেটাই মুসলমানদের জন্য আদর্শ হত । সেক্ষেত্রে ‘মদিনা চার্টার’ অনুসরণ করার কথা ছিল । আর ‘মদিনা চার্টার’ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা হলে সেই রাষ্ট্রে ভিন্ন ধর্মের মানুষ সম্মানের সাথে থাকতে পারত । ভিন্ন ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারত । হাদিসে বলা হয়েছে,’যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কোন অমুসলিমকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না’ (বুখারি হাদিসঃ ৫৯৯২) । ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যে অমুসলিমরা থাকতে পারবে এবং তারা যে, যথাযথ নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে –একথা সকলের জানা থাকতো ।
হিন্দুস্থান রাষ্ট্রের জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য । হিন্দুদের আরাধ্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নাম ‘রামরাজত্ব’ । মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন হলে ভারতে রামরাজত্ব ফিরে আসবে । তবে গান্ধিজী এও বলেছিলেন যে, কেউ যেন ভুলবশত মনে না করেন যে, রামরাজ্য মানে হিন্দুর শাসন । তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন রামরাজ্য এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না; ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানুষে মানুষে কোন বৈষম্য থাকবে না । এই বিষয়গুলো ১৯৪৭ সালে সমাধান করা হলে ধর্ম নিয়ে ভারত বাংলাদেশ- উভয় দেশের যে সমস্যা, তা এভাবে চলমান থাকার কথা নয় ।
পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে । মুসলিম নেতারা সবাই ঢাকায় । কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখনও কলকাতায় । তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব নেই । তাঁর গাড়ি বোমা মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । কয়েকবার তাঁর উপর আক্রমণ হয়েছে । হিন্দুরা তাঁকে মেরে ফেলতে চায় । কলকাতা ছাড়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষবারের মত তাঁকে বলেন, “চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন ?’
তিনি বলেন, ‘যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে ? ...সমস্ত নেতা চলে গেছে, আমি চলে গেলে ওদের আর উপায় নাই ।“(অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃষ্ঠা ৮২, শেখ মুজিবুর রহমান) ।
(চলবে)
১০ ডিসেম্বর, ২০২০ । ইস্কাটন, ঢাকা ।