রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয়(ছয়)
প্রকাশ: ১২:১৯ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:৫৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শীতের সকাল । আমি রমনা পার্ক পার হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যাণে । সেটাও পার হয়েছি । রমনা কালি মন্দির ছাড়িয়ে আমি এখন তিন নেতার মাজারে । ঐতিহাসিক তিনি নেতার মাজার । স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার বিখ্যাত তিন নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন - এই তিন নেতার মাজার । মিলের দিক থেকে তাঁরা তিনজনই মুসলমান এবং বাঙালী রাজনীতিবিদ । ইংরেজ আমলে তাঁরা তিনজনই বিভিন্ন মেয়াদে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং ইংরেজ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন । ১৯৬৩ সালে স্থপতি মাসুম আহমেদ এবং এস এ জহিরুদ্দিন প্রখ্যাত এই তিন নেতা স্মরণে তাঁদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন । কিন্তু স্মৃতিসৌধের কোথাও তিন নেতার নাম উল্লেখ না থাকায় অনেকে বিভ্রান্ত হন । মাজার বেষ্টনী ঘেঁষে ত্রিপল/ পলিথিন দিয়ে ঢাকা ফুটপাতের দোকানগুলো । এখনও দোকান খোলার সময় হয়নি । আমি তালাবদ্ধ মাজার বেষ্টনীর গেটের সামনে দাঁড়াই । জানা যায় সাধারণের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ । শুধুমাত্র নেতাদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে ফুল দেওয়ার জন্য ভিতরে প্রবেশ করা যায় ।
আমাদের ইতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষন এবং প্রদর্শনে বেশ অনিহা । পৃথিবীর অনেক দেশে এই তিন নেতার থেকে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত স্মৃতিসৌধ দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকে । এ ধরণের সংরক্ষণ ও প্রদর্শন কোন ব্যবসায়িক কারণে নয়, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন । কোনকিছুর ভবিষ্যৎ বুঝতে যেমন বর্তমানকে জানতে হয়; তেমনি বর্তমানকেও বুঝতে অতীত জানতে হয় । কারণ, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সুতোই গাঁথা । অতীত এবং বর্তমান বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না নিয়ে, কোন জাতি ভবিষ্যতে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে যেতে পারে না ।
এই তিন নেতার মধ্যে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন ‘বাংলার বাঘ’ বা ‘শের- এ- বাংলা’ নামে খ্যাত জনাব আবুল কাশেম ফজলুল হক । ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন । বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে মিশে যাওয়া পাহাড়সম জনপ্রিয় নেতা ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত ছিলেন । একবার রাজনীতি বিষয়ে তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে তাঁর বাবা তাঁকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে নিষেধ করেন । তাঁর মা সায়েরা খাতুন তাঁকে বলেন, ‘”বাবা যাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না ।“ শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই । (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা ২২, শেখ মুজিবুর রহমান) । বঙ্গবন্ধু সব সময় তাঁর বাবা মায়ের এই উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করেছেন ।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট গঠনে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন । বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট ক্যাবিনেটে পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি । শেরে বাংলা সব সময় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করেছেন । তিনি ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন । এ সময়কালে ১৪৮ বার তিনি বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান । তারমধ্যে ১২৮ বারের বক্তব্যে তিনি মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ দানের কথা বলেন । শিক্ষা বিস্তারে তাঁর এই অবদানের জন্য তৎকালীন শিক্ষাবিভাগের ডিপিআই হরনেল সাহেব তাঁকে ‘বাংলার বেন্থাম’ উপাধি দেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম তাঁর নামে নামকরণ করা হয় । তাঁর শিক্ষানুরাগের কারণে তাঁর মৃত্যুর পর কার্জন হলের বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় তাঁকে দাফন করা হয় । শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার মানুষকে যেমন ভালোবেসেছেন, বাংলার মানুষও প্রাণ উজাড় করে তাঁর প্রতিদান দিয়েছে । তাঁর নামে রাজধানী ঢাকার একটি এলাকার নাম শেরে বাংলা নগর । বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত । ঢাকা ও খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে হল রয়েছে । ১৯৩৮ সালে পাক ভারত উপমহাদেশের প্রথম কৃষিশিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নামে । সেই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নাম শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।
তিন নেতার দ্বিতীয় নেতার নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী । ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর, লেবাননে বৈরুতের একটা হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি । তাঁর মৃত্যু অনেকে রহস্যজনক মনে করেন । গণতান্ত্রিক রীতি এবং জনমতের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার কারণে তাঁকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলা হয় । তবে একজন মানুষের মেধা, দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা যে, তার নিজের জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, তার বাস্তব উদাহরণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী । তাঁর কার্যকাল ছিল ৩ জুলাই, ১৯৪৬ থেকে ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ । পাকিস্তান স্বাধীন হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ । দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবার কথা । কিন্তু, তাঁর পূর্বসূরি ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন । তিনি ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান । তারমানে জন্মগতভাবে তিনি পূর্ব বাংলার সন্তান । হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলমান হলেও তাঁর জন্মভূমি পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুরে । কূটচালে পারদর্শী খাজা নাজিমুদ্দিন শর্ত দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আগে পূর্ব বাংলার নির্বাচনে জয়ী হতে হবে । তখনও কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু মুসলমানদের দাঙ্গা চলমান । ইতোমধ্যে দাঙ্গার শুরুতেই ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে কলকাতায় ৫ হাজার মানুষের নৃশংস মৃত্যু ঘটেছে । যাদের মৃত্যু হয়েছে, তারা অধিকাংশই মুসলমান । প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি দাঙ্গা দমনে হিমশিম খাচ্ছেন । এ সময়ে তাঁকে পূর্ববাংলার নির্বাচনে অংশ গ্রহনের প্রস্তাব ! এই প্রহসনের নির্বাচনে জয়ী হয়েই খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসাবে ঘোষণা দেন এবং দলবল নিয়ে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন । চলমান দাঙ্গায় ভারতে থাকা মুসলমানদের ভাগ্য কি হবে ? পূর্ববাংলার যারা কলকাতায় ব্যবসা বানিজ্য গড়ে তুলেছিলেন তাদের সম্পত্তির কি হবে ? এসবের কোনটাই তিনি ভাবেন নি । ওদিকে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিষয়টি একই রকম । লর্ড মাউনটব্যাটেন চেয়েছিলেন ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তিনিই একইসাথে দুটি দেশের গভর্নর জেনারেল থাকবেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মত যুবক নেতারাও তাই চেয়েছিলেন । কিন্তু, ‘জিন্নাহ রাজি হলেন না, নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে বসলেন’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা ৭৪, শেখ মুজিবুর রহমান) । হয়ত এ কারণেই জনাব জিন্নাহও তড়িঘড়ি করে দিল্লি ছাড়েন । মূলত এই দুই নেতার তড়িঘড়ি করে ভারত ছাড়ার কারণেই কয়েকটি মৌলিক বিষয় অনিষ্পন্ন থেকে যায় ।
এক) ভারতে মোঘল ও ব্রিটিশ ঐতিহ্য মণ্ডিত স্থাপত্য যেমন তাজমহল, ভিক্টোরিয়া পার্ক এগুলো নির্মাণে পূর্ব বাংলার অর্থও ব্যয় হয়েছিল । ভারত ভাগ হলে এসব স্থাপত্যের উপর পূর্ববাংলার হিস্যা কি হবে ?
দুই) পূর্ববাংলার নবাব, জমিদারসহ অন্যান্য সম্পদশালী মানুষ, যারা কলকাতা এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, তাদের সম্পত্তির মালিকানা কি হবে ?
তিন) মুসলমান প্রধান দেশ হিসাবে পাকিস্তান এবং হিন্দু প্রধান দেশ হিসাবে হিন্দুস্থান (ভারত) নামে যে নতুন দুটি দেশের জন্ম হবে, সেই দুটি দেশের প্রকৃত সংজ্ঞা কি হবে ? অর্থাৎ পাকিস্তান মানে কি শুধুই মুসলমানদের দেশ ? আর হিন্দুস্থান মানে কি শুধুই হিন্দুদের দেশ ? ভিন্নধর্মের মানুষ এ দুটি দেশে থাকবে কি ? থাকলে তাদের অবস্থান কি ধরণের হবে ?
বিদায়ী ব্রিটিশরাজ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তৎকালীন ভারতের গণপরিষদের দুটি দল –মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে এই কয়টি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা তখন অতীব জরুরী বিষয় ছিল । পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন না হয়ে, ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট স্বাধীন হলে কোন ক্ষতি ছিল না । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়’ ( ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা ৭৪, শেখ মুজিবুর রহমান) । এই খেসারতের ভয়াবহতা যে কি হতে পারে, ভারত বাংলাদেশ- এ দুটি দেশের জনগণ বর্তমানেও তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে । (চলবে)
ইস্কাটন, ঢাকা । ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ।