রাশেদুল ইসলাম
শেরপুরের সকাল (শেষাংশ)
প্রকাশ: ০৯:২৯ পিএম, ১১ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ০২:১৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আমার শেরপুর আসা একটা শিক্ষা সমাবেশে । শাহিন মিয়ার এনজিও প্রতিষ্ঠান আয়োজিত শিক্ষা সমাবেশের প্রধান অতিথি আমি । মধুটিলা ইকোপার্কের মাঠে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে প্যান্ডেল করা হয়েছে । একদল সেচ্ছাসেবক অতিথিদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন । ৫০০/৬০০ জনের সমাবেশ । স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামনে আসন নিয়েছেন সবাই । শাহিন মিয়া যে সামরিক বাহিনীর লোক, এই সুশৃঙ্খল জনসমাবেশ তার বড় প্রমাণ । মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসাবে নালিতাবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডঃ ফজলে রাব্বি সাদেক আহমাদ, শেরপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতিসহ অনেকে উপস্থিত । সমাবেশে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের স্মৃতিচারণ করে । শাহিন মিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে তাদের মানসিক অবস্থার হৃদয় বিদারক বর্ণনা সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে ।
প্রেসক্লাবের সভাপতি তাঁর বক্তব্যে প্রাচীনকালে শেরপুরের ঐতিহ্য তুলে ধরেন । শাহিন মিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে নতুন করে একটা জাগরণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন । উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া ছেলেমেয়ে খুঁজে বের করে শিক্ষিত করা কোন সৈনিকের কাজ নয় । আমরা সকলে নিজেদের কাজ ঠিকমত করিনি বলেই শাহিন মিয়াকে এই কাজ করতে হচ্ছে । এটা আমাদের জন্য খুব লজ্জার । তিনি তাঁর বক্তব্যে তিনি ডপসকে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন । অন্যান্য বক্তাগণ তাঁদের বক্তব্যে ঝরেপড়া ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি তাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শাহিন মিয়ার অবদানের প্রশংসা করেন এবং তাঁকে সার্বিক সহায়তা প্রদানের অনুরোধ জানান ।
যে কোন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে । কিন্তু আমার নিজের জ্ঞান সীমিত । আবার তেমন কোন সুবক্তা নই আমি । আমার চিন্তা সাধারণ মানুষের মত । কথাবলাটাও সাধারণ মানুষের । আমার মনে হয়েছে, যে কোন সৎকাজের এক ধরণের শক্তি থাকে । যে শক্তিতে করোনার এই মহাদুর্যোগের মাঝেও অপরিচিত একজন শাহিন মিয়া আমাকে ঢাকা থেকে নিতে পেরেছেন । তবে শাহিন মিয়া যা করেন, তা আপনার আমার সকলের কাজ । শাহিন মিয়া করছেন; আপনি আমি সেটা করছিনে । আমার মনে হয়েছে নিচের তিনটি কারণে আপনার আমার সকলকে অন্য মানুষের কল্যাণে কাজ করা উচিতঃ
১। নৈতিক কারণঃ প্রাণী জগতে সবচেয়ে অসহায় প্রাণী এই মানুষ । একটি নবজাত শিশু এবং তার মাকে দেখলে এ কথার সত্যতা সহজে বোঝা যায় । শিশু জন্মের পর সেই মা এবং শিশুর প্রতি যদি কেউ কোন যত্ন না নেয়, তাহলে মা ও শিশু দুজনেই মারা যেতে পারে । মা যদিওবা বাঁচতে পারে, কিন্তু কেউ যদি কোন যত্ন না নেয়, তাহলে শিশুটি নির্ঘাত মারা যাবে । একটি শিশুকে বড় হওয়ার জন্য যে কতজনের কোলে চড়তে হয়, আগুন ও পানির হাত থেকে বাঁচার জন্য একটি শিশুর কতজনের যে সাহায্য লাগে -তার হিসাব করা সম্ভব নয় । আইনে বলা হয় ১৮ বছর বয়স না হলে একজন শিশু সাবালক হয়না । এই ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যেতে একজন শিশুকে যে কত ধরণের মানুষের সাহায্য লাগে, তার হিসাব নেই । তারমানে একজন মানুষ জন্মগতভাবে পরনির্ভর । অন্যের সাহায্য ছাড়া সে বাঁচতে পারে না । কেউ যদি বলে, সে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে, তাহলে সে মিথ্যাবাদি । কারণ, একজন মানুষের নিজের চেষ্টায় বড় হওয়ার কোন সুযোগ নেই । কারো সাহায্য নেওয়া এক ধরণের ঋণ । এ কারণে কেউ যদি কারো সাহায্য গ্রহন করে, তাহলে সেই ঋণ শোধ করা তার নৈতিক দায়িত্ব । যেহেতু আপনি আমি সকলে অন্যের সাহায্য নিয়ে বড় হয়েছি; তাই, অন্যকে সাহায্য করা বা মানুষের কল্যাণে কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ।
২। ধর্মীয় কারণঃ সকল ধর্মেই অন্যকে সেবা করার বিধান রয়েছে । আমি ইসলাম ধর্মের কথাই বলি । পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সৎকাজে কে এগিয়ে আছে, তা পরীক্ষা করার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে“ (সূরা মূলক, আয়াত ২)। তারমানে শাহিন মিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আরও অনেক ভালো কাজ করার জন্য ধর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা ঋণগ্রস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করোনা’ । মানুষ জন্মগতভাবে ঋণী । তাই ধর্মীয় কারণে নিজেদের ঋণমুক্তির জন্যও অন্য মানুষের কল্যাণে কাজ করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ।
৩। ব্যবসায়িক কারণঃ সাধারণত মানুষ মাত্রই নিজেকে জাহির করতে চায় । অন্য মানুষ তার নাম জানুক, প্রশংসা করুক - এটাই মানুষের চাওয়া । এ কারণেই মানুষ নিজের ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি চায় । কিন্তু একজন মানুষ মৃত্যুর পরও যদি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে অন্য মানুষের জন্য কাজ করতে হবে । অন্যের জন্য কোন কাজ না করে কেউ বিখ্যাত হয়েছেন; বা শুধু নিজের পবিবার পরিজনদের জন্য জীবনপাত করে কেউ অমর হয়েছেন – এমন কোন উদাহরণ দুনিয়ায় নেই । যারা পৃথিবীতে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে অন্য মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন । তাই যারা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চান, তাদের অবশ্যই সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করতে হবে ।
ডপস শিক্ষার্থীদের প্রায় সকলেই জীবনে শাহিন মিয়ার মত হতে চেয়েছে । তারমানে তারাও শাহিন মিয়ার মত অন্যের কল্যাণে কাজ করতে চায় । আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কেন জানি মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে । একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ নিজের এবং নিজের পরিবারের ভালোমন্দ ছাড়া আর কিছু বোঝে না; এমনকি অনেকে নিজের বাবামাকেও বোঝা মনে করে । কিন্তু শাহিন মিয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়ে স্বার্থপর না হয়ে, অন্য মানুষের কল্যাণের কথা ভাবছে । এটা ব্যতিক্রম এবং শিক্ষণীয় ।
আমাদের পক্ষে অনেক কারণেই শাহিন মিয়া হওয়া সম্ভব নয় । কিন্তু এ ধরণের শাহিন মিয়াদের পাশে দাঁড়ানো বোধহয় তেমন কঠিন কিছু নয় । নিজেদের অবস্থানে থেকে কথা দিয়ে, অর্থ দিয়ে বা অন্য কোনভাবে আমরা দেশের শাহিন মিয়াদের মত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি - এই কথাগুলোই আমি শিক্ষা সমাবেশের প্রধান অতিথি হিসেবে সেদিন বলতে চেষ্টা করেছি ।
কোন এনজিও সরকারের প্রতিপক্ষ নয় । বরং, এনজিওগুলো সরকারের সহায়ক শক্তি এবং অনেক বড় শক্তি । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কাউকে পিছনে ফেলা নয়; সকলকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই কাজ করছেন শাহিন মিয়ার মত মানুষেরা । এ ধরণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় করোনা মহামারির এই মহাদুর্যোগ কাটিয়ে ২০৪১ সালের লক্ষ অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ- এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের ।
আমাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য শেরপুর জেলা প্রশাসনকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হউন ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ।