রাশেদুল ইসলাম
হজ্জ শেষে নিজের দেশে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জুলাই,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৩৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
পবিত্র হজ্জ পালন শেষে এখন দেশে ।
ফিরেছি কাল রাতে । বিমান বন্দরে আমার নিজের মেয়েরও আমাকে চিনতে কষ্ট হয়েছে ।
চেহারা এবং কষ্ট যাই ই হোক, আমাদের দলের ৫ জন সকলেই যে পবিত্র হজ্জ পালন শেষে সুস্থ শরীরে দেশে ফিরতে পেরেছি, এজন্য মহান আল্লাহর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা । আমাদের জন্য আপনারা দোয়া করেছেন । এজন্য আপনাদের সকলের প্রতি আমাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
মদিনা থেকে দেশে ফেরার আগে আমরা জিনের পাহাড় নামে খ্যাত একটা জায়গা দেখতে যাই । সেখানে একটা উঠের পাশে তোলা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর একটি ছবি এখানে আপলোড করা হোল । ছবিটি দেওয়ার কারণ এই যে, নিজের বয়স যে এত বেশি হয়ে গেছে, এতদিন নিজেই সেটা বুঝতে পারিনি । পবিত্র হজ্জ আমাকে নিজের বয়স এবং প্রত্যাশিত বয়স ও বাকি কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা দিয়েছে । এজন্যও মহান আল্লাহর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ।
জিনের পাহাড়ের উল্লেখযোগ্য একটিই বৈশিষ্ট । এই পাহাড়গুলোর পরে আর কোন রাস্তা নেই । কেউ কেউ বলেন জিনেরা এরপর আর কোন রাস্তা করতে দেয়নি । ফেরার পথে এখানে ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে ব্রেক এ পা দিয়ে বসে থাকেন । গাড়ি নিজে নিজেই ১০/১২ মাইল পর্যন্ত চলে । স্টিয়ারিং ঠিকমত ধরে ব্রেক চেপে না রাখলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে । কারণ, এসময় গাড়ির গতিবেগ ১১০/১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে বলে আমাদের ড্রাইভার জানান । কথিত আছে, এখান থেকে গাড়িগুলো জিনেরা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
আমাদের মত যুক্তিবাদি মানুষেরা জিনের পাহাড় দেখে তেমন একটা মজা পান না । তাঁদের অনেকেই মনে করেন, এখানকার পাহাড়গুলোতে চুম্বক জাতীয় পদার্থ আছে । সেই চৌম্বকীয় শক্তি গাড়িগুলো টেনে নিয়ে যায়। একজন উচ্চশিক্ষিত বাঙালি হাজি এ বিষয়ে অনেক যুক্তি দিলেন। শেষে বললেন, এটা এখানকার সব ড্রাইভারদের সাজানো ব্যাপার হতে পারে। কাকতালীয় ভাবে সেই ভদ্রলোক রাতে নিজেকে হোটেলের মেঝেতে আবিস্কার করেন । তিনি জীবনে কখনো ঘুমের মধ্যে খাট থেকে পড়ে যাননি । তাহলে কিভাবে তিনি মেঝেতে এলেন ! ঘুমের মধ্যে পড়ে গেলে শরীরের কোথাও না কোথাও ব্যাথা হওয়ার কথা ছিল; সেটাই বা নেই কেন ? তিনি বার বার তাঁর বিস্মিত হওয়ার কথা বলতে থাকেন। শেষে আমি মজা করার জন্যই বলি, ‘আপনি নিজে জিনে বিশ্বাস করেন না তো, তাই ভদ্রভাবে জিনেরা আপনাকে একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে’।
আসলে মজা করে বলি, আর যাই বলি, ধর্ম আচরণের বিষয়টি সত্যিই অদ্ভুত । আমি নিজে মূলত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ‘সহজাত বিচারবুদ্ধি’ নিয়ে কথা বলি। সবকিছু নিজের সহজাত বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিচার করি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, জগতে অনেক বিষয় আছে যা নিজের ‘সহজাত বিচারবুদ্ধি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন যমযম কূপের পানি । একটা কূপ পানির গুণগত মান সম্পূর্ণ ঠিক রেখে শত শত বছর একইভাবে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের পানির তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ের সত্যতা আমার নিজের ‘সহজাত বিচারবুদ্ধি’ যুক্তি দিয়ে মিলাতে পারে না । এটা নিঃসন্দেহে অলৌকিক এবং সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অশেষ রহমতের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।
(চলমান)
১২ জুলাই, ২০২৩ । ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা ।
(দুই)
হজ্জ ৩ প্রকার । আমরা যে হজ্জ করেছি বা বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত যে হজ্জ করেন, তাকে হজ্জে তামাত্তু বা তামাত্তু হজ্জ বলে । এই হজ্জ প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশি একজন মুসলমান একটি ওমরাহ ও একটি হজ্জ এক সাথে করার সুযোগ পান ।
হজ্জের ৩ টি ফরজ এবং ৬ টি ওয়াজিব । এই ফরজ ও ওয়াজিবের ৯ টি ধর্মীয় অনুশাসন কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তোষটির জন্য হিজরি যিলহজ্জ মসের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিন (৮ যিলহজ্জ থেকে ১২ যিলহজ্জ) ও সময়ের মধ্যে যথানিয়মে সম্পাদন করার নাম হজ্জ ।
হজ্জের ৩টি ফরজ- যথাক্রমে এহরাম বাঁধা, আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং ক্বাবা শরীফের চারিদিকে প্রদক্ষিণ বা তওয়াফে জিয়ারত ।
হজ্জের ৬টি ওয়াজিব-যথাক্রমে ১। সাফা- মারওয়া সাঈ করা, ২। মুযদালিফায় রাত্রিযাপন, ৩। মিনার জামারায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ ৪। কোরবানি করা ৫। মাথা ন্যাড়া করা বা মুন্ডানো এবং ৬। ক্বাবা শরীফে বিদায়ী তওয়াফ করা । এছাড়া আরাফার ময়দানে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে মিনায় রাত্রিযাপন করা সুন্নত।
হজ্বের প্রথম ফরজ এহরাম বাঁধা । সেলাই বিহীন সাদা কাফনের মত দুটি কাপড়ের একটি বিশেষ কায়দায় পরে এবং অন্যটি গায়ে জড়িয়ে খোলা মাথায় লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষের ক্ষণে ক্ষণে উচ্চস্বরে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুমা...’ ধ্বনিসহ তাঁদের বিশেষ প্রকৃতির সুশৃঙ্খল মৌন মিছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ।
আমি নিজে সদা শয়তানের কুমন্ত্রণায় দিগভ্রান্ত পাপীতাপী একজন মানুষ । আমার হজ্জ কবুল হওয়ার বিষয়টি মহান আল্লাহ্ ভালো জানেন । কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে, হজ্জ পালনরত সবাই আমার মত পাপীতাপী নন । হাজীদের মধ্যে অনেক আওলিয়া, দরবেশ এবং পরিশুদ্ধ মানুষ রয়েছেন । হজ্জ পালন করতে গিয়ে আমি তাই শতশত দেশি-বিদেশি হাজির ধর্মীয় আচরণ পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি ।
মিনা ও আরাফায় আমি মুগ্ধ চোখে দেখি বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ কিভাবে ছোট একটি তাবুর মধ্যে ৪০/৫০ জনের সাথে গাদাগাদি অবস্থায় প্রশান্তিময় সময় কাটান । একজন হাজী কিভাবে একটা টয়লেটের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন; তাঁর নিজের পালা যখন আসে, তখন কেউ যদি পিছন থেকে বলেন, ‘আমারটা বেশি জরুরি’, তিনি হাসিমুখে তাঁর সুযোগ করে দেন । আমার নিজের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এই মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই নিজেরা সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করেন, নিজের অপকর্ম দিয়ে প্রতিবেশীর ঘুম হারাম করে ফেলেন এবং কোন না কোন ভাবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করেন । তাহলে কি পবিত্র মক্কা মদিনায় তাঁদের আচরণ কৃত্রিম ? আমার নিজের তা মনে হয়নি । আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি হজ্জ পালনরত মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আচরণের যে প্রকাশ ঘটে, সেখানে দৃশ্যত কোন কৃত্রিমতা নেই ।
তাহলে প্রশ্ন, সমস্যা কোথায় ?
আমাদের মুয়াল্লেম জানান, হজ্জ পালনরত হাজীর পিছনে শয়তান লেগে থাকে; যেন কোনভাবেই একজন হাজী ঠিকমত হজ্জ করতে না পারেন। শয়তানের প্রথম চেষ্টা থাকে হজ্জ ব্যবস্থাপনার প্রতিটি বিষয়ে খুঁত বের করা । অনেকে হজ্জের সময় মোটামুটি ঠিক থাকলেও হজ্জ শেষে দেশে ফেরার পথে তাঁর পূর্ব মূর্তিতে ফিরে যান । দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যে আগের অবস্থা হয় তাঁর । সবার ক্ষেত্রে এমনটি হয়, তা নয় । তবে হজ্জ পালনরত হাজীদের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতার যে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়, আমাদের সমাজ জীবনে তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না ।
আমরা আগ্নেয়গিরির কথা জানি । অনেক আগ্নেয়গিরি আছে বছরের পর বছর সুপ্ত অবস্থায় থাকে । কিন্তু সেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যখন জীবন্ত হয়ে স্রোতের মত লাভা নির্গমন করে, সেই অনিয়ন্ত্রিত অগ্নুৎপাত মানুষের কোন কল্যাণ করে না । কিন্তু, একটি ছোট্ট দিয়াশলায় কাঠির মুখে যে সামান্য বারুদ থাকে, তা মানুষের উপকার করার অনেক ক্ষমতা রাখে । হজ্জের সাথে বিষয়টি তুলনীয় নয় । তবে হজ্জ পালনরত মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার যে প্রকাশ ঘটে, তা যদি সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হয়, তাহলে গোটা সমাজের চেহারা বদলে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন, তা কি সম্ভব ? হলে কিভাবে সম্ভব ।
(চলমান)
১৪ জুলাই, ২০২৩ । ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা ।