রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (পাঁচ)
প্রকাশ: ০৮:৫৮ পিএম, ১৭ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:৫৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শুক্রবারের সকাল । এ সময়টা আমার একান্ত নিজের । অফিস বা বাসার কোন টান নেই । রমনা পার্ক ছাড়িয়ে একটা ওভারব্রিজ পার হয়েছি আমি । আমার ডানদিকে শাহবাগ- ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) রোড । রাস্তাটি রমনা পার্ক এবং রমনা রেসকোর্স ময়দানকে দু’ভাগ করেছে । ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে এ রাস্তাটি নির্মাণ করা হয় । আমার বাদিকে স্বাধীনতা জাদুঘরের তোরণদার । আমি আসলে ব্রিটিশ আমলের রমনা রেসকোর্স ময়দানে যেতে চাই ।
ব্রিটিশ আমলের সেই রমনা রেসকোর্স ময়দান এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান । কিন্তু আমার সেই আশির দশকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এটি নয় মনে হয় । আমি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল আমার নিয়মিত প্রাতঃভ্রমন কেন্দ্র । কিন্তু এখনকার চিত্র ভিন্ন । এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে । ২০১৫ সালের ২৫ শে মার্চ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয় । মোঘল আমল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস এখানে বিধৃত আছে । তবে এসব কথা পরে ।
আমি একটা শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে । এটি রমনা রেসকোর্স সংলগ্ন কালি মন্দিরের পুকুর । পুকুরটি খনন করা হয় ১৮২৫ সালে । ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ডস এই পুকুর খনন করান । তিনি যখন রমনার এই অংশে ঘোড়দৌড়ের মাঠ তৈরি করেন, তখন পুরানো মন্দিরের এই অংশটি বাদ রাখেন । তিনি মন্দির এবং আশ্রমের ভক্তদের জন্য এই পুকুর খননের ব্যবস্থা নেন । বাংলাভারতের যে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জলাশয়ের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । কিন্তু রমনা কালিমন্দিরের আশেপাশে কোন জলাশয় না থাকায়, তিনি এই ব্যবস্থা নেন বলে আমার মনে হয়েছে । তবে মজার ব্যাপার, একই মন্দির এবং আশ্রমের শতাধিক ভক্তকে ১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে । শুধু তাই নয় পাকহানাদার বাহিনী কালিমন্দির এবং আনন্দময়ী আশ্রমটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় । গোটা কালিমন্দির এলাকা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ।
এখানে দুটো প্রশ্ন,
এক- ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাতকে নিষ্ঠুরতম গনহত্যার ভয়াল কালরাত বলা হয় । তাহলে কোন কারণে অন্যদের মত ঢাকা থেকে পালিয়ে না গিয়ে নারীশিশুসহ শতাধিক ভক্ত- পূজারি রমনা কালিমন্দিরে ছিলেন ?
দুই- পাকহানাদার বাহিনীই বা কেন ২৫ শে মার্চ রাতে রমনা কালিমন্দিরে হত্যাযজ্ঞ না চালিয়ে ২৭ শে মার্চ রমনা কালিমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রমে থাকা সকলকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে ?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, রমনা কালিমন্দির ভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন মন্দির । শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতসহ আশেপাশের অন্যান্য দেশ থেকেও সনাতন হিন্দু ধর্মের মা কালি ভক্তদের অনেকেই এখানে আসেন এবং অনেকদিন অবস্থান করেন । তাছাড়া এখানে আনন্দময়ী আশ্রমও রয়েছে । ভাওয়ালের রানি বিলাস মনি দেবী মা কালির ভক্ত ছিলেন । তিনি কালিমন্দিরে ভদ্রকালির মূর্তির পাশে ভাওয়ালের কালীমূর্তি স্থাপন করেন । রানি বিলাস মনি দেবী কালিমন্দিরের পুকুর সংস্কারেরও ব্যবস্থা নেন ।
১৯৭১ সালে রমনা কালি মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন স্বামী পরমানন্দ গিরি । তিনি ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে যতটা জানতেন তাতে তাঁর এই বিশ্বাস ছিল যে, মন্দির ও আশ্রমে থাকা মানুষ মুসলমানদের কাছে নিরাপদ । কারণ, ইসলাম ধর্মমতে মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নির্যাতন করা বা হত্যা করা নিষেধ ।
স্বামী পরমানন্দ গিরির ধারণা সঠিক । কারণ, পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোন জোরজবরদস্তি নেই’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৬) । মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি; বরং তাদের সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়েছে । বলা হয়েছে,’যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কোন অমুসলিমকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না’ (বুখারি হাদিসঃ ৫৯৯২) ।
দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, পাকহানাদার বাহিনী কালিমন্দিরের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ২৫ শে মার্চ রাতের গণহত্যার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেছে । তাদের মনে হয়েছে, কালিমন্দিরে অবস্থানরত অমুসলিমদের হত্যা করা হলে, এদেশের মুসলমানরা মনে করবে যে, পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় । আর তাদের যুদ্ধ মূলত হিন্দুদের বিরুদ্ধে । এ কারণেই তারা ২৭শে মার্চ রমনা কালীমন্দিরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে । কিন্তু তাদের সেই ব্যাখ্যা এদেশের সাধারণ মানুষ গ্রহন করেনি ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিসাবে ভুল করেছে । তারা ইসলাম ধর্ম বা এদেশের মুসলমান কোনটাই ঠিকমত বুঝতে বা চিনতে পারেনি । প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকে এদেশে শিক্ষার হার কম হলেও, ধর্ম, বিবেক ও নৈতিকতা শিক্ষার দিক থেকে এদেশের মানুষ শতভাগ শিক্ষিত । বাংলার মানুষ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে । শুধুমাত্র ধর্মের কারণে তাদের মধ্যে কখনও কোন বিরোধ হয়নি । মোঘল সম্রাটগণ মুসলমান ছিলেন । কিন্তু তাঁরা কখনও তাদের রাজ্য থেকে হিন্দু বা অন্য ধর্মের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি । আর চাননি বলেই তাঁরা দুশো বছর রাজত্ব করতে পেরেছেন । মহাশক্তিধর ইংরেজও কখনও এদেশের মানুষের সংস্কৃতি বা ধর্মকে সরাসরি আঘাত করেনি । ম্যাজিস্ট্রেট ডসের উদাহরণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে । এসব কারণে ইংরেজও ভারতে প্রায় দুশো বছর রাজত্ব করতে পেরেছে । কিন্তু, পাকিস্তানি শাসকরা তা পারেনি । কারণ, তাঁরা এদেশের মানুষের আবহমানকালের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে আঘাত করেছে ।
মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন । তিনিই পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন । তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁকে ‘কায়েদে আজম’ (মহান নেতা) এবং ‘বাবায়ে কওম’ (জাতির পিতা) বলা হত । সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয় নেতা ১৯৪৮ সালে যেদিন এই রমনা রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’; তখন সেদিনের এই একটি কথাতেই এদেশের বাঙালিদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে । কারণ, জিন্নাহর এই বক্তব্য ছিল আবহমান বাংলা সংস্কৃতির প্রতি একটি বড় আঘাত ।
(চলবে)
সার্কিট হাউজ, টাংগাইল । ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ।