এসব কী হচ্ছে বাংলাদেশে?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ নভেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:২২ এএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে এই অভিযোগ এখন যে কোনও বদ-লোকই করছে এবং নিরীহ নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করছে, তাদের জেলে পাঠাচ্ছে, তাদের নির্বাসনে পাঠাচ্ছে, জীবন তাদের দুর্বিষহ করে তুলছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে কারা বসে আছেন? কারা ধর্মব্যবসায়ী এবং জিহাদিদের অন্যায় আবদার এবং অভিযোগ গ্রহণ করছেন, কারা মামলায় সায় দিচ্ছেন, এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের হেনস্থা করার, শাস্তি দেওয়ার আদেশ দিচ্ছেন? তাঁদের চিহ্নিত করা দরকার এবং জনগণের স্বার্থে তাঁদের অপসারণ অত্যন্ত জরুরি। দেশকে এই নারীবিদ্বেষী, অমুসলিমবিদ্বেষী, অমানবিক, অনুদার, বর্বর জিহাদি মানসিকতার লোকদের হাত থেকে বাঁচানোটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২৮ বছর আগে আমার বিরুদ্ধে ধর্ম ব্যবসায়ীরা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। উন্মাদ হয়ে উঠেছিল মূলত ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থে। তখন দেশের লোকেরা বলেছিল এ আমার সমস্যা, আমাকেই সামলাতে হবে। খুব কম লোকই আমার পক্ষে ছিল। ভেবেছিলাম গণতন্ত্র দাঁড়াবে বাক স্বাধীনতার পাশে। কিন্তু সরকার আমার পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ালো ধর্ম ব্যবসায়ীদের পাশে। ওরা যা দাবি করেছিল, সরকার ওদের সব দাবি মেনেই কাজ করেছিল। আমার বই নিষিদ্ধ করেছিল, যারা আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল, কারও মাথার দাম ঘোষণা করা বাংলাদেশের আইনে অবৈধ হলেও সরকার তাদের বিচারের ব্যবস্থা করেনি, বরং তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তাদের সংসদে বসিয়েছিল। আর আমার বিরুদ্ধে সরকার নিজে মামলা করেছিল, আমি নাকি কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আমার বিরুদ্ধে। আমাকে পায়ে মাড়িয়ে মাথায় তুলেছিল ধর্মব্যবসায়ী উগ্র বর্বর মৌলবাদীদের। সরকার কি তখনই দেশকে হাজার বছর পেছনে টেনে নিয়ে যায়নি? টেনে যে নিয়ে গেছে তার তো নমুনা দেখতে পাচ্ছি। ধর্মব্যবসায়ীদের ক্ষমতা এখন এতই প্রচন্ড যে দেশের সরকারও তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। দেশজুড়ে তারা জ্বালাও-পোড়াও করলেও তাদের বিচার করার সাহস কারও নেই। আসলে ধীরে ধীরে মন্ত্রীসভায়, পুলিশে, সেনাবাহিনীতে, বিচারব্যবস্থায়, নারীবিদ্বেষী, অমুসলিমবিদ্বেষী, স্বাধীনতাবিরোধী, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী কট্টরপন্থী জিহাদিরা ঢুকে গেছে। ঢুকে গেছে বলেই পুলিশ অপরাধীকে মুক্তি দিচ্ছে, নিরপরাধকে হেনস্থা করছে, ঢুকে গেছে বলেই বিচারক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অজুহাতে বিচারের নামে নিরপরাধকে জেলে পুরছেন, শাস্তি দিচ্ছেন।
মেঘদল নামের একটি দলে গান বাজনা করা কিছু স্বপ্নবান তরুণ অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে গান গেয়েছিলেন ১৫ বছর আগে, সেই গান নাকি অনুভূতির রাজনীতি করা কোনও এক ধর্মান্ধের ভালো লাগেনি। তাই মেঘদলের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করল সেই লোক। অবাক কান্ড, এই চক্রান্তকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। মামলা রুজু হলো।
এই কদিন আগেও আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ, আমার কোনও একটি লেখার জন্য, যে লেখার শিরোনাম ‘ধর্ষকের কাছে নারীর কোন ধর্ম নেই’। কোনও একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে ২০১৮ সালে ছাপা হয়েছিল লেখাটি, সেটি নাকি কার অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। মুশকিল হলো, ধর্ষণের প্রতিবাদ করলে ধর্ষকের পুরুষানুভূতিতে আঘাত লাগে, নারীর সমানাধিকারের দাবি করলে নারীবিদ্বেষীদের লিঙ্গানুভূতিতে আঘাত লাগে। সত্যি কথা বললে মিথ্যেয় ভরা কুৎসিত মনে আঘাত লাগে। আঘাত কোথাও না কোথাও তাদের লাগেই। জ্যান্ত মানুষ হলে আঘাত লাগবেই। এ নিয়ে মায়াকান্না, আহাজারি-যা কিছুই ঘটে সবই কিন্তু নাটক।
সরকার আইসিটি আক্টের ৫৭ ধারা তৈরি করে এই সমাজের বিষধর জিহাদি অপশক্তিকে বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে। এরা এখন যাকেই পছন্দ নয়, তাকেই হত্যা করবে। তবে চাপাতি নিয়ে নিজেদের আর কোপাতে হবে না, আইনই মারবে মুক্তচিন্তকদের। ধর্মীয়রা কুপিয়ে তো মারছেই। আমাকে নির্বাসনে থাকতে হয়, মুক্তচিন্তকদের মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হয়, নয়তো দেশ থেকে পালাতে হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জিহাদিদের ভয়ে রাতের অন্ধকারে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করতে হয়। এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা। তবে শেষ অবধি দেশে বাস করবে কারা? অগুনতি বোবা কালা লোক, আর জঙ্গি, জিহাদি।
আমাকে দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না দেশের কোনও সরকারই, কিন্তু দেশটি আমার। দেশ কোনও সরকারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে তারা চাইলেই দেশের নাগরিকের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে। কিন্তু আমাদের হতভাগ্য দেশের হতভাগ্য গণতন্ত্রের এমনই হাল যে যা হওয়ার নয় তা-ই হয়। দেশকে আমি যতটা ভালোবাসি, তত কিন্তু খুব কম লোকই ভালোবাসে। তাই আমার বিরুদ্ধে যুগের পর যুগ দেশের মানুষের অপপ্রচার আর অপবাদ সত্ত্বেও, সরকারের ভয়ঙ্কর বিরোধিতা সত্ত্বেও আমি দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক স্বাধীনতা, নারীর সমানাধিকার, সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই করি। আজও। দেশ থেকে দূরে থেকেও করি।
ওয়াজ ব্যবসায়ীরা দেশের অধিকাংশ তরুণের মস্তিষ্কে অপসংস্কৃতি আর অপশিক্ষা এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, এরা এখন রোবটের মতো ছুটোছুটি করে ধ্বংসলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরা ত্রাস সৃষ্টি করছে যত্রতত্র। ওয়াজ ব্যবসায়ীরা ওয়াজ মাহফিল থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জন করছে, সারা দিন যে ইহুদি নাসারাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, সেই ইহুদি নাসারাদের তৈরি ইউটিউবে ওয়াজ আপলোড করেও পকেট ভারি করছে। এরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যা বলে, তা বিশ্বাস করে না। এরা লোক ঠকানোর ব্যবসা করে। এই ওয়াজ ব্যবসা এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ওয়াজিরা কোনও বিনিয়োগ ছাড়াই এখন কল্পনাতীত ধন সম্পদের মালিক। সমাজে অন্ধকার আর কুসংস্কার ছড়ানো ছাড়া, বিদ্বেষ আর ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া তাদের কিন্তু কোনও অবদান নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিভীষিকার মতো। কত মানুষ যে এই আইনের শিকার! খবরে পড়েছি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দশম শ্রেণির ছাত্রী দীপ্তি রানী দাসও এই আইনের শিকার। বছর খানিক আগে দীপ্তিকে ট্রেন থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে থানায় সোপর্দ করেছিল কিছু লোক, তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়েছিল। দীপ্তি নাকি ওই লোকগুলোর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিল। দীপ্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল পার্বতীপুর পুলিশ। এরপর থেকে বারবারই দীপ্তি জামিন চাইছে, তাকে আজও জামিন দেওয়া হয়নি। হাইকোর্টও তাকে জামিন দেয়নি। যে ভয়ঙ্কর অপরাধের জন্য দীপ্তিকে জেলে রাখা হয়েছে, তা হলো একজন নারীর ঊরুর ওপর রাখা ধর্মগ্রন্থের একটি ছবি ফেসবুকে শেয়ার করা। ছবিটি নাকি মুসলিমদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। দীপ্তি বলেছে, তার আইডি হ্যাক হয়েছে। কিন্তু কেউ শোনেনি তার কথা। ঠিক যেমন রসরাজ দাস আর টিটু রায়ের নামে হিন্দুবিদ্বেষী কিছু লোক নিজেরাই আইডি তৈরি করে নিজেরাই গুজব ছড়িয়ে নিজেরাই হিন্দুদের বাড়িঘর দোকানপাট মন্দির ভেঙে চুরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক সে রকম। কিশোরী দীপ্তি পড়ে আছে রাজশাহীর সংশোধন কেন্দ্রে। তার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ আর হলো না। তার বাবা বলেছেন পার্বতীপুরে তার থাকাও আর নিরাপদ নয়। হার্ডওয়্যারের দোকান দীপ্তির বাবার। ক্রেতারা তার দোকানে আর আসছে না। ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। দীপ্তি জামিন পেলে পার্বতীপুরে বাস করতেই পারবে না, পড়াশোনা করা তো দূরের কথা। সে কারণেই দীপ্তির মা বলেছেন জামিন পেলে দীপ্তিকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাঁরা এমন তো ধনী নয় যে ভালো কোনও আইনজীবী পাবেন দীপ্তির মুক্তির জন্য লড়াই করার, এমন তো ধনী নয় যে ছাড়া পেলে দীপ্তিকে নিয়ে নিরাপদ কোনও শহরে চলে যেতে পারবেন। এই ডিজিটাল আইন একজন প্রতিভাময়ী কিশোরীর জীবন নাশ করে দিয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সমাজের নিরাপত্তা যারা নষ্ট করে তাদের কোনও শাস্তি হচ্ছে না, শাস্তি হচ্ছে শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষের। ভুক্তভোগীদের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে।
সমাজের জন্য যে শিক্ষাটা খুব জরুরি তা হলো, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত বাক স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতাকে সম্মান দিতে চাইলে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হবে। মানুষের যে কোনও অনুভূতিই ব্যক্তিগত। এই অনুভূতিকে যারা আদালত পর্যন্ত নিয়ে যায়, তারা সমাজবিরোধী লোক। প্রতিনিয়ত মানুষের নানা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, মানুষ জানে কী করে এই আঘাতপ্রাপ্ত অনুভূতি নিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না, এই দাবি বাক স্বাধীনতাকে হত্যা করার জন্যই করা হয়। বাক স্বাধীনতাকে হত্যা করতে পারলেই গণতন্ত্রকে নির্মূল করা সহজ হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রকে নির্মূল করে ধর্মতন্ত্র আনার লোক কিছু কম নয় দেশে। এরা নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহী এবং রাষ্ট্রবিরোধী লোক। সুতরাং কারও বলায়, কারও চলায়, কারও গানে, কারও আঁকায় যদি তোমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তবে সেই অনুভূতির শুশ্রƒষা তোমাকেই করতে হবে। আনকোরা আঘাতহীন অনুভূতি নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাওয়ার আবদার বড় শিশুসুলভ, বড় বাস্তবতা বিবর্জিত।
মানুষের এই কথা জানা খুব দরকার যে যারা ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবসা করে, তারা ক্রমাগতই অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে বা অন্যের আদর্শে বিশ্বাসে আঘাত করে যাচ্ছে। তারা অন্য আর কিছুতে পারদর্শী না হোক, অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করায় বেশ পারদর্শী। যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে দাবি করে অন্যের সর্বনাশ করতে চায়, আমি একশ’ ভাগ নিশ্চিত যে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আসলে কোনও আঘাত লাগে না, তারা যে কোনও ছুতোয়, ছলে বলে কৌশলে প্রগতিশীলদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
সরকারকে কঠোর হতে হবে। ধর্ম ব্যবসা, ওয়াজ ব্যবসা, অনুভূতি ব্যবসার শেকড় ধরে সজোরে টান দিতে হবে, জঞ্জাল উপড়ে ফেলতে হবে। সেই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষকে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশের আর যা কিছুই হওয়া সম্ভব, সভ্য হওয়া সম্ভব নয়।