avertisements 2

বেড়েছে মৌসুমি ভিক্ষুক, বেশির ভাগই নারী

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:০৭ এএম, ২২ নভেম্বর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ১২:৩৯ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

গৃহকর্মী রহিমা বেগম (৩০)। স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। দুই সন্তান নিয়ে মিরপুর এলাকায় থাকতেন। গত মার্চ মাস পর্যন্ত চারটি বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু করোনা ভাইরাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে রহিমার আয়রোজগার। গত এপ্রিলের পর থেকে বাসাবাড়ির কাজ বন্ধ। প্রথম দিকে দুই-তিন মাস দুটি বাসাবাড়ি থেকে মাসিক টাকা পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনটি বাসা থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। মহামারির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে অন্যের ত্রাণের টাকায় চললেও এখন নিরুপায় তিনি। তাই বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার পর ভিক্ষা করেন। আগের মতো বাসাবাড়ির কাজ পেলে ভিক্ষা করবেন না বলে জানিয়েছেন রহিমা।

গত রবিবার শ্যামলীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে রহিমা জানান, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিক্ষা করছেন তিনি। কাজ পেলে ভিক্ষা করবেন না। শুধু রহিমা নন, এমন অসংখ্য নারী ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন, যারা আগে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। মৌসুমি ভিক্ষুকের সংখ্যা এমন বৃদ্ধি পেয়েছে যে নগরীর জনাকীর্ণ কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করলে পাঁচ থেকে ছয় জন ভিক্ষুকের মুখোমুখি হতে হয়।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে তছনছ হয়ে গেছে নগরীর ক্ষুদ্র ও দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা। দিন আনা দিন খাওয়া সঞ্চয়হীন মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। পেটের দায়ে নগরীর পথে পথে ভিক্ষা করছেন অসহায় ও নিঃস্বরা। করোনা ভাইরাসের আগে রাজধানীতে তুলনামূলক ভিক্ষুকের উপস্থিতি কম ছিল। বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলির মোড়ে, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, চায়ের দোকান, বিপণিবিতান, বেশি যানজটের সড়ক ও ট্রাফিক সিগন্যাল, মসজিদ, বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, এটিএম বুথ বা বন্ধ হয়ে থাকা শপিং মলের সামনে এখন দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য অসহায় নারী, যারা কাউকে দেখলেই সাহায্যপ্রার্থনা করছেন। সবার দ্বারে দ্বারে গিয়ে হাত পাতছেন। মানিব্যাগ বের করলে বা কেউ গাড়ির দরজা খুললেই সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এসব নারীর সঙ্গে থাকছে শিশুসন্তানেরাও। মায়ের সঙ্গে তারাও করুণ চাউনি নিয়ে তাকিয়ে থাকছে কিছু পাওয়ার আশায়। বেশির ভাগ মধ্যবয়সি এসব নারী কখনোই ভিক্ষুক ছিলেন না। পথে পথে মানুষ বসে আছে ভিক্ষার আশায়। বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে এখন ভিক্ষা করছেন।

কাওরান বাজারে বাবার চিকিত্সার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলেন নূরজাহান। ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাবা ভ্যানচালক। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। বাবা বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। কিন্তু চিকিত্সার ব্যয় বহনের ক্ষমতা নেই তাদের। তাই বাবার চিকিত্সার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন। নূরজাহানের পাশাপাশি এমন সময় অসহায়ের মতো সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন রিজিয়া। তিনি জানালেন, নিউমার্কেটে একটি দোকানে দর্জির কাজ করতেন। এখন কাজ বন্ধ। পেটের জ্বালায় ভিক্ষা করছেন তিনি।

কমপক্ষে ২০ জন নারী ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরা কেউ গৃহশ্রমিক, মার্কেটের দর্জির কাজ, সেলাই শ্রমিক, বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহ, হোটেলে রাঁধুনীর কাজ, উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে বসতভিটা ডুবে যাওয়ায় ঢাকায় কাজের আশায়, ফুটপাতে দোকানদার, কেউ বিভিন্ন মার্কেটে আলু-পেঁয়াজ বাছাই করার কাজ করতেন। সামান্য যে বেতন পেতেন, সেই টাকা আর স্বামীর আয় মিলিয়ে তারা ভালোই চলতেন। অনেকেই আবার বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ায় নিজের আয় দিয়েই কষ্ট করে সংসার চালাতেন। আগে কষ্ট হলেও অনিশ্চয়তা ছিল না। নিম্ন বা স্বল্প আয়ের এই শ্রমজীবী সংগ্রামী নারীদের জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ ঘোর অন্ধকার।

দেশে এখন প্রকৃত কত মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, করোনা ভাইরাসের আগে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ভিক্ষুক ছিল। তবে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) হিসাবমতে, দেশে ১২ লাখ মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত। তবে করোনা ভাইরাসের পরে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখে গিয়ে ঠেকেছে। ঢাকা শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা ৫০ হাজার। করোনার পরে নতুন করে আরো ৫০ হাজার মৌসুমি ভিক্ষুক যোগ হয়েছে।

২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘শিশুর অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা’ শিরোনামে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর উচ্চ আদালতে ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে রিটের পর ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীসহ দেশের সব স্থানে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বিমানবন্দর এলাকা, হোটেল সোনারগাঁও, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হোটেল র্যাডিসন, বেইলি রোড, ধানমন্ডি, গুলশান, কূটনৈতিক জোন ও দূতাবাস এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে এসব এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে বিভিন্ন রকম সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে পাওয়া ভিক্ষুকদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এখন আড়াই লাখের মতো ভিক্ষুক রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে ভিক্ষুকদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য সমন্বিতভাবে কোনো জরিপ হয়নি বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2