দুই মাসে যুক্তরাজ্যে ১৯৯ প্রপার্টির ঋণ পরিশোধ করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:৩৬ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
যুক্তরাজ্যে প্রপার্টি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি নগদে অর্থ পরিশোধের সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ পরিশোধ করে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ ঋণের বিপরীতে বন্ধক হিসেবে ওই সম্পদের ওপর ‘রেজিস্ট্রেশন অব চার্জ’ আরোপ করে। এটি আরোপের মধ্য দিয়ে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে বন্ধকি সম্পদ বিক্রির অধিকার পায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান। রেজিস্ট্রেশন অব চার্জ আরোপের পর পুরো অর্থ পরিশোধ করা হলে তখন ‘স্যাটিসফ্যাকশন অব চার্জ’ গঠন করা হয়।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয় গত ৫ আগস্ট। ওই সময় থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ১৯৯টি প্রপার্টির বন্ধকি ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে স্যাটিসফ্যাকশন অব চার্জ সম্পন্ন করেছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন দুই কোম্পানি। ২১ আগস্ট শুরু করে সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার আগেই এ অর্থ পরিশোধ করা হয়। দুই মাসে এ দুই কোম্পানির বিপুল পরিমাণ ‘চার্জ স্যাটিসফাই’ বা ঋণের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি কোম্পানির অতীত রেকর্ডের সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক বলে দাবি করছেন তারা।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর একটি হলো জেডটিএস প্রপার্টিজ লিমিটেড ও আরেকটি রুখমিলা প্রপার্টিজ লিমিটেড। ২১ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্রিটিশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রপার্টি খাতের কোম্পানি দুটি থেকে ১৯৯টি প্রপার্টির বন্ধকের অর্থ পরিশোধ করা হয়। এর মধ্যে জেডটিএস রুখমিলা প্রপার্টিজ লিমিটেডে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে অংশীদার হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রী রুখমিলা জামান।
যুক্তরাজ্য সরকারের তথ্যে জানা যায়, জেডটিএস প্রপার্টিজ লিমিটেড এ দুই মাসে ১১১টি প্রপার্টির ঋণ পরিশোধ করেছে। এ সময়ে এ দুই প্রতিষ্ঠানের নতুন কোনো প্রপার্টিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান চার্জ আরোপ করেনি। এসব প্রপার্টিতে অর্থায়নকারী ব্রিটিশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিবিএস ব্যাংক লিমিটেড, মার্কারি ফান্ডিং লিমিটেড, নেপচুন ফান্ডিং লিমিটেড, আর্থেইভ ব্রিজিং লিমিটেড, জিরকন ব্রিজিং লিমিটেড, টুগেদার কমার্শিয়াল ফাইন্যান্স লিমিটেড, পার্ল ব্রিজিং লিমিটেড, গার্নেট ব্রিজিং লিমিটেড, ক্রেডিট ক্যাপিটাল করপোরেশন লিমিটেড, তিলিয়া ব্রিজিং লিমিটেড, জুপিটার ব্রিজিং লিমিটেড, মার্কেট ফাইন্যান্স সলিউশন লিমিটেড ইত্যাদি।
অন্য কোম্পানি রুখমিলা প্রপার্টিজ লিমিটেড ২১ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৪টি প্রপার্টির ঋণ পরিশোধ করেছে। এগুলোয় অর্থায়ন করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মার্কারি ফান্ডিং লিমিটেড, নেপচুন ফান্ডিং লিমিটেড, আর্থাইভ ব্রিজিং লিমিটেড, জিরকন ব্রিজিং লিমিটেড। এসব প্রপার্টির বিপরীতে চার্জ গঠন করা হয় ২০২০ সাল থেকে। এ চার বছরে টানা চার্জ গঠন করা হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি, যা বাংলাদেশে সরকার পতনের পর দুই মাস পেরুনোর আগেই পরিশোধ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট নথির তথ্য অনুযায়ী, ২১ আগস্ট, ২২ আগস্ট, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পরিশোধ করা হয়। এর মধ্যে ১১ সেপ্টেম্বর মার্কারি ফান্ডিং লিমিটেডের আটটি, একই দিন নেপচুন ফান্ডিং লিমিটেডের ১০টি, ১৯ সেপ্টেম্বর আর্থেইভ ব্রিজিং লিমিটেডের ২৫টি, জিরকনের তিনটি, গার্নেট ব্রিজিং লিমিটেডের ছয়টি সম্পদের ঋণ পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে জিরকনের সাতটি, পার্ল ব্রিজিংয়ের ১৭টি, আর্থেইভের একটি ঋণ পরিশোধ করা হয় ২১ আগস্ট। পরদিন ২২ আগস্টই সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করেছে জেডটিএস প্রপার্টিজ। ওইদিন পরিশোধ করা হয় জিরকনের ১৮টি, ক্রেডিট ক্যাপিটালের দুটি, তিলিয়ার চারটি, জুপিটার ব্রিজিংয়ের সাতটি ও মার্কেট সলিউশনের একটি ঋণ। রুখমিলা প্রপার্টিজ লিমিটেড এ সময়ে ক্রয়কৃত সম্পদের বিপরীতে বন্ধকি ঋণ পরিশোধ করেছে ৮৪টি। এর মধ্যে ২১ আগস্ট ৩২টি, ২২ আগস্ট ২৪টি, ১১ সেপ্টেম্বর ১০টি ও ১৯ সেপ্টেম্বর ১৭টি প্রপার্টির ঋণের অর্থ পরিশোধ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাজ্যের স্কয়ার মাইলস সলিসিটরের পরিচালক ও সলিসিটর ফজলে ইলাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে প্রপার্টি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বেশকিছু সুবিধা রয়েছে। কোনো কোম্পানি প্রপার্টি ক্রয় করতে চাইলে কিছু অংশ নগদ পরিশোধ করে বেশির ভাগ অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া যায়। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কোম্পানির ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তিনি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে প্রপার্টি ক্রয় করেছেন বলে ধারণা করা যায়। প্রপার্টি ক্রয়ের পরে ঋণ প্রদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউজে চার্জ রেজিস্ট্রেশন করে, যা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কোম্পানির ক্ষেত্রেও হয়েছে। তবে সম্প্রতি অনেকগুলো ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। এক সঙ্গে এতগুলো প্রপার্টির অর্থ পরিশোধ করাটা অবশ্যই সন্দেহের উদ্রেক করে। এ অর্থের উৎস কী, এসব অর্থ অবৈধ কিনা, কোথা থেকে এসব অর্থ এসেছে—সে বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের তদন্ত করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দুই কোম্পানি যদি আইনিভাবে চার্জগুলো স্যাটিসফাই করে, সেক্ষেত্রে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে কোম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এবং সম্ভাব্য চার্জগুলো স্যাটিসফাই করার মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়। এর মাধ্যমে হয়তো তিনি বাংলাদেশ সরকারকে টাকা ফেরত পেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছেন।’
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের বিষয়টি সামনে আসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। ওই সময়ে সম্পদের কথা বলা হলেও তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গণ-অভ্যুত্থানের পর সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট। প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যে চৌধুরীর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ৩৬০ প্রপার্টির অস্তিত্বের কথা জানানো হয়।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এত অল্প সময়ে এ বিপুল পরিমাণ সম্পদের বন্ধকি ঋণ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের রিসার্চ অ্যানালিস্ট জুলকারনাইন শায়ের সামি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসব অর্থের উৎস অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। কীভাবে তিনি এখানে এত সম্পদের মালিক হলেন তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের একটা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন চেয়ারম্যান। এস আলম ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীরা একই সঙ্গে আত্মীয়ও। এস আলমের মালিকানাধীন অনেক ব্যাংক এখন আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকটে ভুগছে। দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ নিয়ে এখানে তারা বিভিন্ন ধরনের শেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেসব কোম্পানির মাধ্যমে এসব করছেন তারা। বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী হয়েও সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিনিয়োগ করেছেন। এসব দেশে আমরা তার সাত শতাধিক প্রপার্টির সন্ধান পেয়েছি। অথচ সরকারের আয়কর হিসাবে এসব সম্পদের কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। এমনকি নির্বাচনের সময়ের হলফনামায়ও এসব সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। তার মানে তিনি আয়কর ও হলফনামায় মিথ্যা, অসত্য ও ভুল তথ্য দিয়েছেন। এসব কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয় এবং আইন অনুযায়ী অপরাধ। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা এরই মধ্যে তার নামে তদন্ত শুরু করেছে। এগুলো ফাঁকি দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি কীভাবে এত স্বল্প সময়ে এত সম্পদ তৈরি করেছেন, তার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’
বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগ নিয়ে এরই মধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। একই বছর তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের নামে যুক্তরাষ্ট্রে নয়টি ফ্ল্যাট কেনেন। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা করার জন্য আমিরাতের দুবাইয়ে র্যাপিড র্যাপ্টর এফজিই ও জেবা ট্রেডিং এফজিই নামের দুটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় কিউ গার্ডেনস ও বুটিক রেসিডেন্সে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার দাম ২২ লাখ ৫০ হাজার ৩০০ দিরহাম (প্রায় ৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা)।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কেনেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা)। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিজের ও স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে আটটি প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মূল্য ২১ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার ডলার (প্রায় ২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা)।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত যে ২১টি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, সেই তালিকায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী বা তার পরিবারের কারো নাম নেই। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী যে সম্পদ বিবরণী জমা দেন, সেখানে তার বিদেশে থাকা সম্পদের কোনো তথ্য নেই। অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুসারে এটি অপরাধ।
দুই মাসে পরিশোধিত চার্জের সংখ্যা অস্বাভাবিক জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব লর সদ্য সাবেক গ্র্যাজুয়েট আরিফুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে জেডটিএস প্রোপার্টিজ লিমিটেড ও রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের লিগ্যাল চার্জের স্যাটিসফ্যাকশন অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতদিন পর্যন্ত কোম্পানি দুটির রেজিস্ট্রেশন অব চার্জ গঠন করা হলেও এ সময়ে সব ঋণ স্যাটিসফায়েড হয়ে যায়। এ সময়কালে অন্য কোনো উৎস থেকে কোম্পানি দুটির পক্ষ থেকে ঋণ গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায় না। এটা নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত হওয়া উচিত। তাহলে অর্থায়নের উৎস বের হয়ে আসবে।’