মতিউরের এত সম্পদ, অনুসন্ধানে দুদক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ জুন,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:৪৩ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সম্প্রতি সৈয়দ মুসফিকুর রহমান ইফাতের ছাগল কেনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। মতিউর রহমান এই তরুণকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করলেও ইফাতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। আর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন মতিউর রহমানের দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা। ইফাত মতিউর রহমানের সন্তান না হলে তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কীভাবে পেল—এমন প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন—সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জমা পড়া অভিযোগটি যাচাই করে কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যেই দুদকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, এর আগে মতিউরের বিরুদ্ধে কমিশনে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল। তবে তাঁর তদবিরের চাপে প্রতিবারই তাঁকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ওই সব অভিযোগ আর অনুসন্ধান করা হবে না। তবে এবার কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র এসেছে। এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। শুধু ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নয়, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন নামে পুঁজিবাজারের আরেক কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে।
জানা গেছে, মতিউর রহমান বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় থাকেন। তার পারিবারিক মালিকানাধীন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে ড. মতিউর রহমানের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার মোবাইল ফোনে কল দিয়েও কথা বলা যায়নি।
গত বুধবার তিনি কালবেলার কাছে দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত তার ছেলে নয়। তার এক ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতা। এর বাইরে তার কোনো সন্তান নেই।
আলোচিত ইফাত কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে বলে জানিয়েছেন তার আত্মীয় ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ছবি তিনি দেখেছেন। এটা তার মামাতো বোনের ছেলে। আর তার বাবা এনবিআর সদস্য ড. মতিউর রহমান। আর মতিউর রহমান তার বোনকে সামাজিক মর্যাদা দেন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। মতিউর রহমান হয়তো রাগ করে ছেলেকে অস্বীকার করছেন বলে ধারণা এ সংসদ সদস্যের।
জানা গেছ, শুধু রাজধানী ঢাকা বা গাজীপুরে নয়, মতিউর রহমান অঢেল সম্পত্তি কিনেছেন শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীতেও। তার স্ত্রী লায়লা কানিজ আগে সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। এখন চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। আর প্রভাবশালী স্বামীর প্রভাবে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লার নামে পার্ক-রিসোর্ট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট। এ ছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। বসুন্ধরার ডি ব্লকে রয়েছে ৫ কাঠায় ৭ তলা বাড়ি, যার দোতলায় মতিউর রহমান পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এ ছাড়াও গাজীপুর সদর, খিলগাঁও মৌজায় এসএ ১৭১ আরএস ২৮০ দাগে ১০ দশমিক ৫০ শতক; এসএ ১৭২ আরএস ২০১ দাগে ৩ দশমিক ৯০ শতক; এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৫ দাগে ৭ দশমিক ৫০ শতক, এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৬ দাগে ৬ শতক; এসএ ১৭০ আরএস ২৭৯ দাগে ৬ শতক; এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৬ দাগে ৭ শতক; এসএ ১৭০ আরএস ২৭৯ দাগে ৬ শতক; গাজীপুর থানার খিলগাঁও মৌজায় ৩৫৫৭ জোতে ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, জোত ৩৪৫০-এ ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং জোত ৩৬৫২-এ ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে শূন্য দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে। গ্লোবাল সুজ লিমিটেড কোম্পানির নামে জোত ১২৫-এ ৩৪৩৪৫ শতক, জোত ৭০-এ ২৮০০ শতক, জোত ৯০-এ শূন্য দশমিক ০৩৩০ শতক জমি রয়েছে। এই ৭টি খতিয়ান মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। এ ছাড়াও সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় খতিয়ান ১৩০৩৫ দাগ ১৭৬৩ ও ১৭৬২-এ ১২ দশমিক ৫৮ শতক জমি রয়েছে। লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় খতিয়ান ১৩৬৯৬-এ ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমি রয়েছে।
মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে শত বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে লাকি পার্ক নামে আলিসান রিসোর্ট, যার বর্তমান নাম ওয়ান্ডার পার্ক। এসব পার্ক করতে গিয়ে জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ছেলের বাবা যদি মতিউর রহমান হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অস্বীকার করে ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন। আর সম্পদ আড়াল করার জন্য বিষয়টি হয়েছে কি না—তা খতিয়ে দেখা দরকার। সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে, তারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ তারা দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, এটা তার যুক্তি। এই যুক্তি তার আয়ের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা খতিয়ে দেখতে হবে।’