avertisements 2

প্রসঙ্গঃ হত্যা ও ধর্ষণ

জালাল উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ০৮:০৯ পিএম, ৩ অক্টোবর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:৫৮ এএম, ২৬ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২৪

Text

সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ এখন এমন এক পর্যায় অতিক্রম করছে যার প্রবাহে জোয়ার এসেছে বলে মনে হয়। যেদিকে তাকাই-এই সম সাময়িকের ভিড়ে মনে হচ্ছে এদের ঈদ বা পুজা-পার্বন চলছে। ঘটনার ঘন ঘটায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোন একটা ইস্যুতে যখন সমাজে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় তখন মানুষ মনে করে সামাজিক জীব হিসাবে তাদের অস্তিত্বে এর চেয়ে বেশী বড় কুঠারাঘাত বোধ হয় আসে নি। এই ঘটনা বা অপঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা যাই বলুন না কেন – সম সাময়িকের এই দুর্বার আচরনগুলো আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বেশ বড় ধরনের আঁচড় কেটে দেয়। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য দেখুন। ঘটে যাওয়া সমসাময়িকের এই ঘা শুকানো বা এর পুর্ণতা পাওয়ার আগেই আরো একটি দুর্বিপাক এসে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে নাড়া দেয়। সেক্ষেত্রে গতকালের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি তখন বাসির খাতায় পড়ে যায়। কারন মনুষ্য সৃষ্ট এইসকল অপঘটনাগুলি এমন সব চমকপ্রদ ও লোমহর্ষক কায়দায় ঘটে বা ঘটানো হয় তখন গতদিনের টাট্‌কা ঘটনাটি বাসি বলে মনে হয়। এবং মানুষ তখন সরকারী পৃষ্টপোষকতায় লালন পালন হওয়া মিডিয়ার কল্যানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপুর্ন সেই গতদিনের অপঘটনাটি বেমালুম ভুলতে বসে। এখানে সরকারী পৃষ্টপোষকতার কথাটি এল এই কারনে যে বিরোধী বা নিরপেক্ষ মিডিয়ার যে দু-চারটি টিমটিমে বাতি এই ভূখন্ডে বিরাজমান ছিল তা গত বছর দশেকের গণতান্ত্রিক চর্চার রাষ্ট্র ব্যবস্থার কল্যানে হিমঘরে ঠাঁই পেয়েছে।  সুতরাং মনুষ্য সৃষ্ট অপকর্মগুলি যা ট্রেজারী বেঞ্চ এর সাঙ্গপাঙ্গরা ঘটায় কিংবা তাদের সংশ্লিষ্টতায় ঘটে; সেক্ষেত্রে নতুন সাড়া জাগানো আজকের টাট্‌কা টি নিয়েই তারা মানুষকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। তখন কাল বা পরশুর  ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না বা ঘামালেও তা পাতে পড়েনা। এবং এভাবেই একের পর এক লোমহর্ষক অপকর্ম এই ভূখন্ডে ঘটে যাচ্ছে। পুরনো ঢেউ যাতে বেগবান হতে না পারে তা চাপা দেয়ার এটা কোন অপকৌশল কিনা তা নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে। কারন যা কিছু হচ্ছে তার তীর কিন্তু ওই ট্রেজারী বেঞ্চের দিকেই ফোকাশ হচ্ছে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে।  

কোন্‌ ঘটনা দিয়ে শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছিনা। যেমন ধরুন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। এই সাত খুনের কথা বলতে গিয়ে চার যুগ আগে সদ্য স্বাধীন বাংলায় ঘটে যাওয়া সেই সেই লোম হর্ষক ঘটনার কথাটি মনে পড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে ঢুকে সরকারী ছাত্র সংগঠনের সেই কুখ্যাত ছাত্র নেতার বীরদর্পে মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ারে সাতজন ছাত্রীকে  মারার ঘটনা ভুলি কেমন করে। সেই হন্তকও আজ পরপারে। কিন্তু সেই হত্যাকান্ড তৎসময়ে যে দাগ কেটেছিল তার রেশ কি এখনো কাঁদায় না নিহত পরিবারের মানুষজনদের! যাহোক ২০১৪ এর ২৭ এপ্রিল নারায়নগঞ্জের সরকার দলীয় এক নেতার ইন্ধনে সরকারী সিভিল প্রশাসনের লোকজন যেভাবে সাতজন মানুষকে লোমহর্ষক কায়দায় খুন করে শীতলক্ষার পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিল তার মূলয়ায়ন কিভাবে করা যায়। নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও একজন উকিলসহ মোট সাতজন মানুষকে সেদিন পরিকল্পনা করে নদীর ধারে নিয়ে খুন করেছিল আমাদেরই ট্যাক্সের টাকায় পালিত আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকজন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এত পরিকল্পিত ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ড হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তার বিচার হয়তো হয়েছে নিম্ন আদালতে। কিন্তু বিচারের রায় কার্যকর করার সদিচ্ছা কি দেখা যাচ্ছে? এমনও শুনেছি ক্ষমতা সংশ্লিষ্টতায় নাকি রাজার হালেই আছে সেইসব সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা। তারপরে ধরুন বিশ্বজিত হত্যা। কি নৃশংশ হত্যাকান্ড! প্রকাশ্য রাজপথে কুপিয়ে কুপিয়ে মারা হোল ছেলেটাকে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া বা এর রায় নিয়ে রয়ে গেল জনমনে অস্বশ্তি। আবরার হত্যা নিয়ে কি হচ্ছে! রিফাত হত্যায়ই বা কি হোল। জনমনে কেন স্বস্তি নেই এসব মর্মান্তিক হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বা রায় নিয়ে? একজন সেনাবাহিনীর তুখোড় কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে মারা হোল। অথচ তার মৃত্যু নিয়ে কি তুলকালামই না চলছে। তাছাড়া গুম বা ক্রস ফায়ারের কথা নাই বা উচ্চারন করলাম। তবে হত্যা হত্যাই। কি হয়েছিল সেদিন বি ডি আরের পিলখানায় যার জন্য বিনা বাধায় দেশের সেনা বাহিনীর এতগুলো অফিসারকে খুন করা হয়েছিল। হেফাজতের শাপলা চত্তরের সম্মেলনে কেনইবা হাজার হাজার মৌলভী ও তালবিলিমকে ঘেরাও করে মারা হোল সে রাতে? কোন্‌ অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবার পরিজন্সহ হত্যা করা হোল? কিংবা রব সেরনিয়াবাদ ও শেখ মনির হত্যার কথাইবা না বলি কেমন করে। দেশের চার অগ্র সৈনিককে জেলের ভিতর যেভাবে খুন করা হোল তার উত্তর কোথায়? কিংবা সিরাজ শিকদারের মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক ছিল? রমনা ভবনের সামনে একুশে আগষ্টের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় কয়েক ডজন তাজা প্রাণের প্রয়াণ কি সভ্য সমাজ স্বীকৃতি দেয়? বাঙালীর প্রাণের উৎসব বৈশাখের প্রথম দিনে রমনা বটমুলে যা ঘটানো হোল সেটা কি সভ্য সংস্কৃতির পরিচায়ক? সাগর-রুনির কি দোষ ছিল? দেশপ্রেমের বলিষ্ঠতায় এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে দায়িত্ব নেয়া একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সম্প্রতি যেভাবে খুন করার মানসিকতায় পঙ্গু করে দেয়া হোল তার উত্তর কি?

ইদানীং ধর্ষন সংক্রান্ত যেসব ঘটনা ঘটছে তার ভিন্নতা নিয়ে কথা বলতেই হয়। শিশু থেকে শুরু করে মাঝ বয়সী ভার্যা কেউ কি বাদ আছে এই ধর্ষন নামক বিভিষিকা থেকে। জাহাঙ্গাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মানিকের শত ধর্ষন করে তা উদযাপন কথার কাহিনী নিশ্চয় সবার মনে আছে। সিলেটের  খাদিজা বেঁচে থাকলেও তার উপর যে নির্যাতন হয়েছিল সেটা কি  ভুলা যায়। বরিশালের বানরী পাড়ায় মা ও মেয়েকে ধর্ষন করে ন্যাড়া করে প্রকাশ্যে রাজপথে প্রভাবশালী তুফান যে কান্ডটি ঘটিয়েছিল সেটার উত্তর কি! কুমিল্লা ক্যন্টনমেন্টের মত সংরক্ষিত এলাকায় তনু নামের মেয়েটিকে ধর্ষন করে রাস্তার পাশে ফেলে গেল কারা? নোয়াখালীতে মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষন করে রুহুল আমিন নামক বীরপুরুষের সেই কান্ডটি আমারা ভুলে গেছি? ফেনির সোনাগাজি ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে তার মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল সিরাজের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেয়াতে কিভাবে পুড়িয়ে মারা হোল তার কথা কি আমারা ভুলতে পারি?  বরগুনার আলোড়িত রিফাত হত্যার সুরত হালই বা কি তা তো চোখের সামনেই দেখলাম। আর সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলে ধরে নিয়ে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নিয়ে গনধর্ষন তো আজকের দিনের তাজা খবর। কয়েক বছর আগে কোন এক সাংবাদিকের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জেনেছিলাম দেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার গৃহকর্মী ধর্ষিত হচ্ছে। বাপ-ছেলে-মামা-চাচা সবারই লোলুপ দৃষ্টি বাসায় কাজ নেয়া ওই অসহায় গৃহবধু বা কিশোরী মেয়েটির প্রতি। সুতরাং আরব দেশের শেখদের দোষ দিয়ে লাভ কি! তারা তো দিয়ে থুয়েই এসব করে। আজকে নারী সমাজের কোথায় স্থান? কেউ কি বলতে পারেন? ছোট কন্যা সন্তানকে হুজুরের কাছে আলিফ বা তা শিখাতে পাঠাবো। স্বস্তি আছে কি সেখানে! মহিলা কর্মজীবি মা-বোনদের শান্তি আছে কি তাদের কর্মক্ষেত্রের উঠানে। হয়তো একজন ডিসির নটঘটের কাহিনী প্রকাশ্য হয়েছে।  কর্মজীবি নারীদেরকে নিয়ে বস পাতি বসরা কি করে তা জাতি জেনেছে। কিন্তু আরো বহু বস বা উপবস ওইসব সরকারী আধা সরকারী অফিসে আছে যারা প্রতিনিয়ত তাদের অপকর্মের ডালি সাজিয়ে কর্মস্থলের পবিত্রতা নষ্ট করে চলেছ। অর্থাৎ নারী ভোগের বস্তু। এর বাইরে যাওয়ার মানসিকতায় আমরা নেই। কখনও প্রেম করে ভালবাসায় সিক্ত করে, কখনওবা চাকুরী যাওয়ার ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভনের টোপ দিয়ে আর সর্বশেষ চাহিদার পশুত্ব আচরনে এর প্রকাশ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে হরদম ঘটে চলেছে। কোনটা নীরবে কোনটা প্রকাশ্যে। তবে নিরাশার কথা একটাই তা হোল এই অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি জাতি অবলোকন করেনি। শত ধর্ষন বলুন, প্রকাশ্য খুন বলুন কিংবা গণধর্ষন যায় বলুন না কেন এই পাষন্ড কর্মের বিচারের শাস্তি বড়ই নগন্য। তাছাড়া যারা এই অপকর্ম করছে বা করতে উৎসাহিত হচ্ছে তারা সব সময় ক্ষমতার বলয়ের আশীর্বাদপুষ্ট থেকে লঘুদন্ড নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিচারের নায্যতা নিয়েও কথা আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইসব অপকর্মের বিচার মৃত্যুদন্ড বা যাবত জীবন। কিন্তু আমাদের দেশে কিভাবে এই বিচারের সাজা হয় কিংবা সময়ের আবর্তে ওইসব সাজা প্রাপ্তরা কিভাবে জেল থেকে মুক্ত হয় তার খবর কমবেশী আমাদের জানা আছে।

আবহমান বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য এবং এর নৈতিক পদচারনা আজ ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অপকরর্মের প্রকার ভেদে রাহাজানি ছিনতাই ধর্ষন মস্তানী গুন্ডামী জমি দখল জিম্মি খুন গুম আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা প্রতিদিনের ইলেকক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এসব অপকর্মগুলি অবাধ ও গতিশীল হচ্ছে শুধুমাত্র দুটি কারনে। আমরা যে রাষ্ট্র কাঠামোয় বাস করছি তা কি স্বচ্ছতায় সাবলীল? যে নেতৃত্বের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বাঙালী রাষ্ট্র কাঠামোর হাজারো অনৈতিক অপকর্মকে জিন্দাবাদ ও জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে ছেয়ে রেখেছে তা কি স্বচ্ছতায় ষোলআনা? যার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে গোটা বাঙালী জাতি এক দেশ এক নেতার মন্ত্র গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন পুরন করলো তাঁর উত্তর পুরুষই তো এখন আমাদের কান্ডারী। দেশ প্রেমের ব্যকুলতা ও বাংলার মাটিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোর দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি যেভাবে তাঁর শ্রম ও মেধা নিষ্কলুষভাবে ব্যয় করে যাচ্ছেন তার মূল্যায়ন কি আমরা করতে পারছি? তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা পরজীবিরা যেভাবে রাজনীতিকে কলুষতায় কদর্য করে রেখেছেন তার উত্তর খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। রাজনীতির প্রথম পাঠে তরুন-যুবারা কলুষিত অনুশীলনে অভিষিক্ত হচ্ছে বিধায় তাদের পথ চলার পরবর্তী ধাপগুলো মাসলম্যান দাদাগিরির উচ্চতায় বিকশিত হচ্ছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে দৃশ্যমান ঘটনাগুলো মুড়ি মুড়কির মত ঘটে চলেছে। কিন্তু কলুষিত রাজনীতির উঠানে এসব শাস্তি যোগ্য অপকর্ম তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কারের খাতায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ফলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার রসদে এসব তরুন যুবারা দূর্বিনীত হয়ে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় কালিমা লেপন করছে। সুতরাং রাজনীতির স্বচ্ছ্বতা,সহমর্মিতা ও প্রশাসনিক দৃঢ়তাই আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অনৈতিক কাজগুলোকে ছেঁটে ফেলতে সহায়ক হবে বলে বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন।  ।

 

বিষয়: ধর্ষণ

আরও পড়ুন

avertisements 2