জালাল উদ্দিন আহমেদ
তুষের আগুন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারী, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:৩৮ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাংলা আর বাঙালী নিয়ে মাঝে মধ্যে আমার অনুভূতির ইনস্টিংক্টটা বিদ্রোহী হয়ে যায়। কিসের এপার ওপার! সবাইতো বাঙালী। সবইতো বাঙালীময়। বাংলা ভাষায় কথা বলছি। বাংলা কবিতা সাহিত্য পড়ছি। বাংলায় গান গাইছি। বাংলায় ঈশ্বর বন্দনা করছি। বাংলায় আল্লাহর কাছে এবাদত বন্দেগী করছি। এই যে ধর্মের নামে বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে একটি মেকি বিভাজনের দেয়াল খাড়া করে রাখা হয়েছে তা কি বাংলার ‘ব’ কে বাও বানিয়েছে না ‘ক’ কে কাই বানিয়েছে? নাকি মাকে মাই বানিয়েছে। তবে এটা ঠিক যে ঊনবিংশে সৃষ্টি হওয়া এক জাতীয় সংস্কৃত গুলে খাওয়া কেতাবী সম্প্রদায় নিজেদের টিকি ও পৈতাকে মূলধন করে পুর্ব বাংলার বাঙালীকে ‘বা’ এবং ঘটি হাতে বাণিজ্য করতে আসা ধুতি পৈতার মধ্য ও দক্ষিন ভারতীয় মাড়োয়ারীর ঘটিকে ‘’ঘ’ বানিয়ে এক দ্বৈত সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এটা প্রকারন্তরে ধর্মীয় জঙ্গনামা সৃষ্টির কোন একদল টিকিওয়ালা সংস্কৃত সেবীর সেই নিজ ধর্মের এসটি এসবি বানানোর কাহিনী কেচ্ছার মতই হবে হয়তো। কিন্তু বাঙাল ও ঘটি সংস্কৃতি সেই যে চার দেয়ালের ভিতর ঢুকেছে, তা থেকে তারা কি বেরোতে পেরেছে! এটাকে নিয়ে ওরাই বোধ হয় রঙ তামাসা ঠাট্টা মস্করা বেশী বেশীই করে। মুক্ত বাংলার বাঙালীয়ানায় এই কালচার চোখে পড়ে না।
বয়স তো আর কম হোল না। এসব নিয়ে লিখেছি। হয়তো সময় পেলে আরো লিখবো। এটা তো তৈরী করা এক জ্বলন্ত তুষের আগুন। একেবারে সুষ্পষ্ট উচ্চারনে একশ্রেনীর আনন্দ বাজারীয়রা এসব নিয়ে এখনো রসিকতা করেন। নাটক নভেল রচনা করেন। বৈঠকি আলোচনায় এই ঘটি বাঙাল উচ্চারন বেশ রসিয়ে রসিয়ে করা হয়। তবে নিজেদের পৈতাটাই ভাল করে ঘি তেলের মালিশ লাগিয়ে ধুতিটার ক্যোঁচটা সামলিয়ে কেতাবী ঢংয়ের প্রমিত বাংলায় আহ্ উহ্ করা ছাড়া আর কিবা আছে তাদের। তাল গাছটার মালিকানা যে ব্রাহ্মন জমিদার রবি ঠাকুরের শিলাইদহ বা পতিসরের চাষাভুষা জমির আলি ও জয়দীপ মন্ডলদের হাতে সমর্পিত হয়েছে, সে খেয়াল কি তাদের আছে! আজকাল জি আই (জিওলজিক্যাল ইনডিকেশন) বা ভৌগলিক ইত্যাদি নিয়ে বাঙালীদের ঠোঁকাঠুকি লেগেছে মনে হয়। আবারও সেই ভারতীয় জোশের জয় হিন্দের মেকি গর্বের ধ্বজা তুলে তারা বাঙালীয়ানায় ঢেকুর তুলে তৃপ্তও হন তারা। এরকম পাকিস্তান জিন্দাবাদের ঢেকুর তুলতে গিয়ে যে বদ-হজমের ঘোরে বাংলার বাঙালীরা পড়েছিল তা তো সার্জারী করেই সারাতে হয়েছিল বলে মনে পড়ে। এখনকার দিনে মধ্য ও দক্ষিনের মাড়োয়ারীরা যেভাবে ধুতি পৈতার বাহুল্য নিয়ে ভারতীয় বাঙালী মধব বৈদ্যের ছাপড়া ঘরের আঙ্গিনায় পাত পেড়ে কচুর শাক আর আলু ভর্তা দিয়ে ইরি চালের গরম ভাতের আতিথ্যে রাজনীতির জয় শ্রীরামের আবাদীতে উন্মত্ত হয়েছে, সেদিনের আচকান শেরওয়ানী ও জোব্বা পরা নারায়ে তাকবীর ওয়ালাদের সঙ্গে এর তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে কি? ভাবতে অবাক লাগে, পশ্চিমের প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জের ভারতীয় বাঙালীর কাছে পুবের স্বাধীন বাঙালীরা এখনো মুছলমান! বাঙালীয়ানার চেতনা যদি কোলকাতার কলেজ স্ট্রীটের চৌহদ্দিতে সীমাবব্ধ থাকে তবে তাকে গ্রাম্য কাহাবতের ‘'যেই শান কি তেই শান, শুটকি কা বেইগুন’’ ছাড়া আর কিইবা বলা যায়!
বাঙালীয়ানার উঠানের একটি ধুলিকনায় ফু দিতে গিয়ে আঁতুড় ঘরের বিড়ালগুলো কেন যে এভাবে দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে আসে- সেটাই মাথায় ঢুকে না। বাঙালী প্রান্ত বদলিয়েছে ঠিকই কিন্তু ভূখন্ডের অস্তিত্ত্বে অটুট রয়েছে। এবং সেই জ্বালা নিয়েই তারা একজন জগদীশ বসু বা কুদরুত-ই-খোদা কিংবা ঋত্বিক ঘটক বা মোঃ শহীদুল্লাহ আনিসুজ্জামান হিসাবে তৈরী হয়েছেন। হয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা প্রমোদ দাশগুপ্ত কিংবা রাজ্জাক মিঠুনের মত যশস্বী। তবে যে যাই বলুন না কেন, বাঙালী একাত্ম বা একাট্টা হয়েছিল ঐ একবারই। নিজেদের অস্তিত্ত্ব বিনির্মানের একাত্তরই হচ্ছে বাঙালীর মাটিতে পা ফেলার একমাত্র অহংকারের মাইলস্টোন। একাত্তরের সেই বাঙালীয়ানার সামগ্রিকতা আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে। হয়তোবা আগরতলা, কৃষ্ণনগর, শিলিগুড়ি বা সীমান্ত সংলগ্ন আরো বহু স্পটসহ কোলকাতার বাঙালীয়ানার সার্বিক সংস্রব না থাকলে পুর্ব দিগন্তের সেই ‘'রক্ত লাল হয়ে উঠা সূর্যটির মধ্য গগনে আসতে আরো কাঠ খড় পোড়াতে হোত। তারপরেও সেখানে আধিপত্যবাদী ব্রাহ্মনীয় আচরন ও সামন্ত প্রভুত্বের মুসলিম মোড়ল কর্তাদের নেগেটিভ কথাবার্তা বাতাসে ভেসেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় আচরনের শক্তপোক্ত বাতাবরনের বৈতরনীতে চড়ে বাঙালী তার কাংখিত গন্তব্যে পা ফেলেছে। বাঙালী তার শাশ্বত অহংকারের মুক্ত জমিন তৈরী করে সামনের দিকে এগিয়েছে।
তবে তৎকালীন পুব-পশ্চিমের গ্যাঁড়াকলে কলেজ স্ট্রীটের তথাকথিত খাস বাঙালীদের কাছে পুবের বাঙালী অধ্যুষিত বাঙাল বা নেড়েদের বাঙালী হয়ে উঠার ব্যাপারটা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় বলেই মনে হয়েছে। গড় পড়তায় এতদাঞ্চলের বাঙালীদের ওরা মুছলমান এবং বাঙাল বলেই সম্বোধন করেছেন। তার প্রমানও পাওয়া যায় কলেজ স্ট্রীটীয় কলমবাজিতে। নাটক নভেল যাত্রা সিনেমায় এখনো এই চ্যাপ্টারটা তারা রগরগে করে রেখেছেন। আর এই মুছলমান ও বাঙালের বিষয়টিও এসেছে ৮০ঃ২০ এর সমীকরনে। অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়ে পুবে থেকে যাওয়া ২০% নিম্ন বর্ণের হিন্দুকে তারা ইঙ্গিত করেছিলেন বাঙাল বলে। আর এই ঘটির বিষয়টি অতি উচ্চারিত না হলেও বৃটিশ ভারতের বাঙাল মুলুকে, এমন কি পুর্ব পাকিস্তানেও পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের কিছু সংখ্যক ঘটি হাতের ধুতি পৈতার মাড়োয়ারী পাট ও চামড়া ব্যবসার আড়তদার হিসাবে টিকে ছিল। এতদাঞ্চলের জনপদে তারা ঘটি হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন। এই ঘটির উচ্চারনটি বোধ হয় এখান থেকেই এসেছে। তবে এই বাংলাদেশে ঘটি-বাঙালের শব্দবাজি আমার কানে এসেছে বলে মনে পড়ে না। হীনমন্যতার ফসল হয়ে এই তীর্যক শব্দ যুগল কেবল কোলকাতা ভিত্তিক সংস্কৃতির আঙ্গিনায় উচ্চারিত হতে দেখি।
তুষের আগুনের আঁচটা কমতে চায়। বার্ধক্যে এসে জীবনটা এখন লাঠিতে ভর করেছে। তবুও কেন যেন ফোর্ট উইলিয়ামের পরম্পরায় সিক্ত উত্তর পুরুষের কিছু অপভ্রংশ এখনো দয়ানন্দজীর সেইসব অনুশীলনের আদলে নিজেদের পরিচিতিটা বাঙালীর সার্বজনীনতায় ফেলতে অনীহা প্রকাশ করেন। সর্বভারতীয় আঙ্গিকে নেতাজী স্বামীজি ও রবি ঠাকুরের স্ফুরনের জোশে একসময় যারা ভারত শাসনের খোয়াব দেখেছিলেন তাদের উত্তর পুরুষেরাই তো এখনও নির্দ্বিধায় উচ্চারন করেন ‘'শ্যামা প্রসাদ বাবুদের বাংলা ভাগের মহৎ উদ্যোগ ছিল বলেই আজ আমরা সৌভাগ্যবান, নইলে বাংলার হিন্দুদেরকে মুসলমানদের অধীনে থাকতে হোত”। ছিঃ! শুনতেই গা ঘিন ঘিন করে। বাঙালীর জন্য সৃষ্টি হওয়া ‘মুখে মধু অন্তরে বিষে’র সেই প্রবাদের মুখের মধু বোধহয় ইদানীং বিষাক্ত হয়ে গেছে! ছোটমুখে বড় কথা না মানালেও এটা বলতে দ্বিধা নেই যে সেদিনের ভারত ভাগের মূল শক্তিই ছিল ওই হিন্দু ইজম। হিন্দুস্তান বাসীর সামগ্রিক নেতা হওয়ার জন্য গান্ধীজি যেকোন সাম্প্রদায়িক আলোচনা সরকারী টেবিলে উঠলেই বলে বসতেন তিনি কংগ্রেসের কেউ নন। এরকম সমস্যা হলেই তিনি তা নেহেরু প্যাটেলদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। এবং তা পরিকল্পিত বলেই মনে হয়েছে। কংগ্রেসের একগুয়েমীর বিষেই বিষাক্ত হয়ে জিন্নাহ সেদিন বিদ্রোহী হয়েছিলেন এবং তিনি একাই সে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। যাহোক ইতিহাস তো আর থেমে থাকে না। বাঙালী তার জাতীয়তাবাদের নিশান উড়িয়েছে। কিন্তু যে সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক বিষফোঁড় তৈরী করে পাঞ্জাব আসাম বাংলাকে ছিন্নভিন্ন করে ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানের জাতিগত বিভাজন যেন তুষের আগুনের ঢিমি আঁচ হয়ে আমাদেরকে এখনো কুরে কুরে খাচ্ছে। এসবের অবসান হবে কিনা সেটা অন্তর্যামীই ভাল জানেন।