হাওরের কৃষকের আনন্দ নেই
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ এপ্রিল,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫৩ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
প্রতিবছর বোরো ধান কাটার পর হাওরের কৃষকের ঘরে ঘরে থাকে উৎসবের আমেজ। ছেলেমেয়ে, বউ-জামাইসহ স্বজনদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয়। ভালো ভালো খাবার রান্না করা হয়।
কোথাও বিয়েশাদিরও আয়োজন চলে। ঈদ থাকলে সেই আনন্দ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এবার উৎসব তো দূরের কথা, দুমুঠো খাবারও জুটছে না কৃষকের।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলায় আগাম বন্যায় অনেক কৃষকের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারলেও অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে যেটুকু ধান পেয়েছেন তা-ও বিক্রি করতে পারছেন না। ৭০০ টাকা মণ দরেও ধান বিক্রি হচ্ছে না। এই অবস্থায় ঋণ পরিশোধ ও পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগাড় করা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় কৃষক।
তাহিরপুর উপজেলার দুর্গম জয়পুর গ্রামের কৃষক নূর উদ্দিন। এ বছর ২৫ কিয়ার (১ কিয়ার = ৩০ শতাংশ) জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে ১১ কিয়ার বর্গা নেওয়া। বিআর-২৮ ধান ১৪ কিয়ার জমিতে এবং বাকি জমিতে বিআর-২৯ ধান লাগিয়েছিলেন। প্রায় ৪০০ মণ ধান পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। ৯ জনের পরিবারের প্রধান এই কৃষক ধান লাগানোর সময় ৫০০ টাকা মণ দরে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা ঋণ এনে চাষ করেছিলেন। নিজের জমানো কিছু টাকাও ছিল। তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলে সালাহ
উদ্দিনও বাবাকে চাষবাসে সহযোগিতা করেছে। তাঁর ছেলের দাবি ছিল, ফসল ওঠার পর কলেজে যাওয়ার জন্য ভালো জামাকাপড় ও জুতা কিনে দিতে হবে। কিন্তু ৫ এপ্রিল নজরখালি বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে তাঁর সম্পূর্ণ ফসল।
নূর উদ্দিন বলেন, ‘ছেলেটা বড় আশা নিয়ে গিরস্থিতে সাহায্য করেছিল। এখন খালি কান্দে। আমি তাকে প্রবোধ দেই। বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঈদে কিছু দিতে পারব না, এই কষ্ট আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রতিবছর ঈদে ধান বিক্রির টাকায় ছেলে ও মা-বাবাকে নতুন জামা দিয়ে থাকি। কিন্তু এবার নতুন জামাকাপড় কেনা তো দূরের কথা, কিভাবে বাঁচব, দাদনের ৬৫ হাজার টেকা পরিশোধ করব, এই চিন্তায় আছি। ’
দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের হুকুমপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম। চার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর সংসার। নিজের ৩০ কিয়ার জমি আছে। এবার ১৮ কিয়ার জমিতে চাষবাসে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। বাকি জমি বর্গা দিয়েছিলেন। নিজের ও বর্গা দেওয়া সব জমির ফসল তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ঈদে ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাকের বায়না ছিল। কিন্তু ফসল হারানোয় তাদের সেই বায়না উবে গেছে। আবুল কালাম বলেন, ‘সংসারে আমি একলা কামাইদার মানুষ। আমার ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ টাকার। এই টাকায় আমার বছরের খোরাকিসহ পরিবারের খরচাদি চলত। এখন কী খাব আর আগামী দিন কিভাবে চলব, এই চিন্তায় আছি। ’
এই গ্রামের ফসলহারা কৃষক আল আমিন। দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫০০ টাকা মণ ধানের দাম ধরে ২৫ হাজার টাকা এনে ২৫ কিয়ার জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। ১৮ এপ্রিল টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারসংলগ্ন আফরমারা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে তাঁর জমি।
আল আমিন বলেন, ‘প্রত্যেক কৃষক ফসল বিক্রির টাকায় স্বজনদের আবদার পূরণ করেন। কিন্তু এবার আমরা সেই ক্ষমতা হারিয়েছি। নিঃস্ব হয়ে গেছি। ’ তিনি বলেন, ২০১৭ সালে সরকার যেভাবে ফসলহারা কৃষকের পুরো বছর খাবার দিয়েছিল, এবারও সেই সহায়তা দেওয়া উচিত। না হলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ঘোর বিপদে পড়বেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, যাঁরা ফসল হারিয়েছেন তাঁদের তালিকা কৃষি বিভাগ করছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেছেন। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে প্রণোদনা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। কৃষি বিভাগ সেই তালিকা করছে।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক ফুল মিয়া জানান, মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ১২ একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তিনি। প্রতি একরে ৬০ থেকে ৭০ মণ ধান পাওয়ার কথা। তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে আধাপাকা ধান কেটে ফেলায় একরে ৩০ থেকে ৩৫ মণ ধান পেয়েছেন। এখন মহাজনী ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
খালিয়াজুরী গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, বিক্রির জন্য রাখা প্রায় ৫০০ মণ ধান কয়েক দিন ধরে হাওরে ফেলে রেখেছি। ফড়িয়ারা কিনতে চাচ্ছে না। সরকার ধানের মূল্য এক হাজার ৮০ টাকা মণ নির্ধারণ করলেও ৭০০ টাকা মণ দরেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।
দাউদপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, এখন কৃষকের হাতে কোনো টাকা নেই। ধানই একমাত্র সম্বল। এই ধান বিক্রি করতে না পারায় কৃষক পরিবারের সদস্যদের এবার পুরনো কাপড় পরেই ঈদ পালন করতে হবে। তা ছাড়া ধানের ফলন কম হওয়ায় ধান বিক্রি করে মহাজনী ঋণের টাকাই পরিশোধ করতে পারবেন না তাঁরা।