মাথার ওপর দুর্নীতির বোঝা , হতে চান জেলা পরিষদ প্রশাসক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৪৮ পিএম, ২ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫
এ কে এম এ আউয়াল
মাথার ওপর দুর্নীতির বোঝা। চলছে মামলা। জব্দ রয়েছে সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব। দুর্নীতির দায়ে জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) পদ হারিয়েছেন। এমন নানান অভিযোগের পাহাড় মাথায় নিয়ে জেলা পরিষদ প্রশাসক হতে চান এ কে এম এ আউয়াল। বিষয়টি এখন পিরোজপুর-১ আসনের টক অব দ্য টাউন।
এ কে এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পাঁচটি মামলা করেছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি ও তথ্য গোপনের দায়ে ২০১৯ সালে ও ২০২০ সালে পাঁচটি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে দুটি মানিলন্ডারিং ও বাকি তিনটি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা। এখন পর্যন্ত জমা দেওয়া তিনটি মামলার তদন্তে তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। মামলার তদন্তে উঠে আসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আউয়াল খাস জমি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে বন্দোবস্ত দেখিয়েছেন।
শুধু আউয়াল নন, তার ভাই পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের বিরুদ্ধে রয়েছে বহু অভিযোগ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক আলী আকবর গণমাধ্যমকে জানান, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাতটি মামলার মধ্যে তিনটি মামলার চার্জশিট জমা হয়েছে আদালতে। বাকি চারটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই এসব মামলার চার্জশিটও জমা দেওয়া হবে।
এমন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির জেলা পরিষদ প্রশাসক হতে চাওয়ায় জেলার নাগরিক সমাজে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, এমন হলে তা হবে পিরোজপুরবাসীর জন্য দুঃখজনক।
তদন্তে উঠে আসে নাজিরপুর উপজেলা সদরে ভিটি বন্দোবস্ত মামলার মাধ্যমে সাতজন ব্যক্তির নামে একসনা বন্দোবস্ত নিয়েছেন। পরবর্তীতে দেখা যায় ওই নামের কোনো ব্যক্তিকে লিজ গ্রহীতা হিসেবে পাওয়া যায়নি এবং খাস জমি আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন দখল করে রেখেছিলেন। যেখানে নিয়মনীতির ব্যত্যয় করে স্ত্রীর নামে নির্মাণ করেছিলেন দোতলা ভবনও।
দুদকের করা অন্য মামলার তদন্তে উঠে এসেছে জেলার অতিপরিচিত রাজার পুকুর ভরাট করে অবৈধভাবে প্রাচীর নির্মাণ করেন সাবেক এমপি আউয়াল, যা তিনি দখলে নিয়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
শক্তির দাপট দেখিয়েছেন জেলার নেছারাবাদ উপজেলায় কয়েকটি মৌজায় বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি দখলের জন্যও। যেখানে নিজ নামে আউয়াল ফাউন্ডেশনের কার্যালয় নির্মাণ করে দখলে রেখেছিলেন।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ধারায়ও বর্তমানে অভিযুক্ত আউয়াল। দুদকের তদন্তে উঠে আসে বৈধ আয়ের বাইরে তিনি ৩৩ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন। বিপরীতে দুদকের কাছে জমা দেওয়া তথ্যে তিনি গোপন করেছেন ১৫ কোটির বেশি সম্পদ।
তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের দায়ে আরেকটি মামলা রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান আর তদন্তে সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালের দুর্নীতির বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে। তাই আদালত আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ বা ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন। সব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতও মহানগর আদালতের সম্পদ জব্দের আদেশ বহাল রেখেছেন।
কাগজ-কলমের দুর্নীতির বাইরেও সংসদ সদস্য থাকার সময়ে আউয়াল ঘুষ বাণিজ্য ও ঠিকাদারিতে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন আর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আলাদা বাহিনী গঠন করেছিলেন।
তার বাহিনীর নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনও অনেকে আঁতকে ওঠেন। তার দুর্নীতি আর অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন তার ভাইসহ নিজ দলের অনেক নেতা। এ কারণে ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি আউয়ালকে।
২০২০ সালের মার্চে শুরুতে আউয়াল পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে তিনটি মামলায় ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় জামিন আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
তাদের কারাগারে রেখে চিকিৎসা ও ডিভিশন দেওয়ারও নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু ওই দিনই ওই বিচারককে বদলির আদেশ পাঠানো হয় এবং যুগ্ম জজ নাহিদ পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর একই দিন বিকেলে আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন আদেশ দেন পিরোজপুর জেলা আদালত। বিচার বিভাগের ওপর সাবেক এমপি আউয়ালের এমন প্রভাব ও ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে ওই সময় দেশে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে আউয়ালের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। তার জামিন বাতিলের ব্যাপারে উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন। শিগগিরই জামিন বাতিলের চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
শুধু সাবেক এমপি আউয়ালেরই ক্ষমতার দাপট নয়। তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও বেপরোয়া। দুদকের তদন্তে একজনের লাগাম টেনে ধরা গেলেও আউয়ালের ছোট ভাই পিরোজপুর সদর পৌরসভার বর্তমান মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকও বেপরোয়া।
মালেক ও তার স্ত্রী নীলা রহমানের বিরুদ্ধেও দুটি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে একটি হলো জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় সাড়ে ৩৬ কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন। অন্য মামলায় বলা হয়, কয়েকজনের সঙ্গে যোগসাজশে মেয়র মালেক পৌরসভায় ২৫ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দেন। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পৌর মেয়র মালেক ও তার স্ত্রী নীলা রহমানের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অনুসন্ধানে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। আর ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার বিষয়েও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই দুই মামলারও চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে যেকোনো সময় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আই অ্যাম ক্লিন ইমেজের মানুষ। প্রতিপক্ষ কেউ আমার বিরুদ্ধে দুদককে দিয়ে মামলা করিয়েছে। আমার সম্পদ বিবরণীতে যা আছে, সবই আয়কর ফাইলে আছে। আর আমার স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদও নেই।’
এদিকে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ কে এম এ আউয়ালকে দল থেকে এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সাবেক এমপি আউয়াল বর্তমানে জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে বসার জন্য তদবির করছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্নীতি মামলা চলমান থাকা অবস্থায় তাকে জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং জনসাধারণের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে দুর্নীতির জালে জর্জরিত আউয়াল তার অপকর্মের জন্য ২০১৯ সালে দলের মনোনয়ন পাননি। এবার তিনি বসতে চান জেলা পরিষদের প্রশাসকের চেয়ারে। এরইমধ্যে স্থানীয় রাজনীতির মাঠে এ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। জেলার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এটা হলে তা হবে আমাদের জন্য দুঃখজনক।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনরায় সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসালে জনসাধারণের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যে ম্যান্ডেট তার সঙ্গে শতভাগ সাংঘর্ষিক হবে।