ছোট ঘটনার বড় মাশুল
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ এপ্রিল,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৩১ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
'তুচ্ছ' ঘটনা। তাতেই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ শুরু। সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থেমে থেমে টানা ১৮ ঘণ্টা চলে এ সংঘর্ষ। ইটপাটকেল, দেশীয় অস্ত্র আর লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু'পক্ষ। একের পর এক বিস্ম্ফোরিত হয় ককটেল; চলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। গতকাল সকালে দীর্ঘ সময় 'নিষ্ফ্ক্রিয়' থাকার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। রক্ত ঝরে তিন পক্ষেরই। সংঘর্ষে নাহিদ হাসান (১৮) নামের একজনের মৃত্যু হয়। আহত হয়ে শতাধিক ব্যক্তি চিকিৎসা নেন হাসপাতালে।
গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নাহিদ। পথচারী নাহিদ দুপুরে নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান হিসেবে চাকরি করতেন তিনি। সংঘর্ষে গুরুতর অবস্থায় দুই শিক্ষার্থীসহ আরও চারজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নিয়ে অনেক দিন ধরেই রাজপথে বড় ধরনের কর্মসূচি নেই; এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও নেই। নিউমার্কেটের ঘটনায় আবার উত্তপ্ত হলো রাজপথ। নিউমার্কেট ও আশপাশের অন্তত ৭০টি মার্কেট বন্ধ থাকায় ঈদের আগে ব্যবসায়ীরাও আর্থিক ক্ষতির শিকার হলেন।
সংঘর্ষের জের ধরে গতকাল রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে যানজট। সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হন নগরবাসী। ছোট ঘটনায় দিতে হয় বড় মাশুল। সংঘর্ষের শুরুতে তা থামাতে পুলিশের অতি উৎসাহ আর শেষের দিকে নিষ্ফ্ক্রিয়তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সংঘর্ষের সময় নীলক্ষেত মোড় থেকে ধানমন্ডি ২ নম্বর, এলিফ্যান্ট রোড ও আশপাশের এলাকার হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ আগামী ৫ মে পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে; শিক্ষার্থীদের বিকেল ৫টার মধ্যে আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে তা না মেনে শিক্ষার্থীরা গতকাল রাত পর্যন্ত হলেই অবস্থান নেন। অবরুদ্ধ করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে। বিকেল থেকে ওই এলাকায় মোবাইল ফোনের দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় কিছু যানবাহন চলতে দেখা গেলেও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন মার্কেটের সামনে দোকানকর্মীদেরও অবস্থান নিতে দেখা গেছে। রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গোটা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। প্রস্তুতি চলছিল মামলা দায়েরের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'এ ঘটনা দ্রুত কুল ডাউন হবে। দায়ীদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে।'
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, 'সংঘর্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার বিষয়গুলো আমরা দেখছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা উস্কানি ও গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি খারাপ করার অপচেষ্টা চলছে।' আহতদের দেখতে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান শিক্ষামন্ত্রী।
কী নিয়ে এই সংঘর্ষ- সে প্রশ্নের জবাব মিলেছে নানামুখী। সোমবার রাতে সংঘর্ষ শুরুর পর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, দুই শিক্ষার্থী কেনাকাটা করতে গেলে দরদাম নিয়ে তর্কের জেরে তাদের ছুরিকাঘাত করেন ব্যবসায়ীরা। এই খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছলে উত্তেজনা ছড়ায় রাতেই। গতকাল ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, এক দোকানে খাবার খেয়ে টাকা না দেওয়ায় প্রতিবাদ করাতেই সংঘর্ষের সূত্রপাত।
অবশ্য বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা গেছে, নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেট এলাকায় 'ওয়েলকাম ফাস্টফুড' ও 'ক্যাপিটাল ফাস্টফুড' নামে দুটি দোকানের দ্বন্দ্বের জেরে সূত্রপাত এই সংঘর্ষের। ইফতারির সময় দুই দোকানের টেবিল বসানো নিয়ে কয়েক দিন ধরে ঝামেলা চলছিল। সোমবার দুই দোকানের কর্মচারীরা মারামারি শুরু করেন। ঢাকা কলেজের কয়েক শিক্ষার্থী ওয়েলকাম নামের দোকানের পক্ষ হয়ে সোমবার রাতে সেখানে যান। তারা ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের মারধর করেন। তখন ওই দোকানের কর্মীরা ছুরি নিয়ে ওই ছাত্রদের ওপর চড়াও হন। ক্যাম্পাসে ছড়ায় ছাত্রদের ওপর হামলার খবর।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আশরাফ উদ্দিন আহমেদ বাবু সমকালকে বলেন, তারাও এমনটাই শুনেছেন। তবে ঘটনার পর থেকে দোকানগুলো খুলতে না পারায় আনুষ্ঠানিক কিছু জানতে পারেননি।
অবশ্য ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন সমকালকে বলেন, সোমবার রাতে তাদের কিছু শিক্ষার্থী নিউমার্কেটে খেতে যায়। সেখানে দুই দোকানের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে তারা আহত হয়। এর প্রতিবাদ করতে গেলে ঝামেলার সৃষ্টি হয়।
১৮ ঘণ্টার সংঘর্ষে রণক্ষেত্র গোটা এলাকা :প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার রাত ১২টার দিকে প্রথমে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসেন। তারা চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও ঢাকা সুপার মার্কেটের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। লাঠিসোটা নিয়ে তারা ধাওয়া দেন। তখন একের পর এক ককটেলের বিস্ম্ফোরণ ঘটে। শিক্ষার্থীরা রামদা, ছুরি নিয়ে পাল্টা ধাওয়া শুরু করেন। দোকানকর্মীদের হাতেও তখন ছুরি দেখা যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শুরুর দিকে লাঠিপেটা করে মাঝে অবস্থান নেয়। ছাত্ররা তখন ক্যাম্পাসের মূল গেটের সামনে থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরাও পুলিশকে ঢাল বানিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ইট ছুড়তে থাকেন।
অন্তত ১০ শিক্ষার্থী বলেছেন, গভীর রাতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে এলোপাতাড়ি টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। তখন তারা কলেজের বিভিন্ন বহুতল ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এতে বহু ছাত্র গুলিবিদ্ধ হন।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত। পরে শিক্ষক প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে মঙ্গলবার দোকান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানায় পুলিশ। তবে রাবার বুলেট ছোড়ার প্রতিবাদে তখনও ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে। রাতে একপর্যায়ে পুলিশের রাবার বুলেট শেষ হয়ে গেলে রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদকে মাঠ পর্যায়ের সহকর্মীদের সঙ্গে উত্তেজিত হতে দেখা যায়। তিনি এক কনস্টেবলের কাছ থেকে রাবার বুলেট চেয়ে তা না পেলে ওই সদস্যকে গালি দিয়ে চড়ও দেন। যে তথ্য ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে।
ছাত্ররা বলছেন, শিক্ষার্থী আহত হওয়ার প্রতিবাদে তারা গতকাল সকাল ১০টার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভ করেন। ওই সময়ে ব্যবসায়ীরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মারতে থাকেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, গতকাল সংঘর্ষ শুরুর অন্তত আড়াই ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সক্রিয় হয় পুলিশ। ততক্ষণে মিরপুর সড়কের দুই পাশে অন্তত ২৫টি মার্কেটের হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মী রাস্তায় নেমে আসেন। শত শত ছাত্রও মারমুখী হন তখন। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর ১টার দিকে ঢাকা কলেজের অদূরে রোগীবাহী দুটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি মাইক্রোবাসে ভাঙচুর চালানো হয়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, দোকানকর্মীরা ওই অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেছে। তবে ব্যবসায়ী নেতারা তা অস্বীকার করেছেন।