avertisements 2

হাওড়ে বাঁধ ভাঙার জন্য দায়ী ইঁদুর আর কাঁকড়া! কর্মকর্তাদের হাস্যকর যুক্তি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ এপ্রিল,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৪৯ এএম, ৩১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে বাংলাদেশের হাওড়াঞ্চলের বিস্তীর্ণ বোরো ধানের আধা-পাকা ক্ষেত। একের পর এক ভাঙছে ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ। ভেসে যাচ্ছে মৎস্য খামার। ঘাম ঝড়ানো ধান চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন। প্রায় প্রতিবছরই এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্বপ্রায় এই অঞ্চলের মানুষ। এর আগে ২০১৭ সালেও আকস্মিক বন্যায় সব হারিয়ে ছিল হাওড় অঞ্চলের মানুষ। হাওড়পাড়ে এখন কৃষকদের কান্নার রোল আর চলছে হাহাকার। শনিবার দুপুর পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে চার হাজার ৯৮৪ হেক্টর জমির ধান। 

এতে ২৫ হাজার কৃষকের প্রায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। বাঁধ ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা আর অনিয়মকে দায়ী করছেন কৃষকরা। তারা ফসল রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করছেন। বাঁধ ভাঙার জন্য এবারও কৃষকরা দায়ী করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের। গাফিলতি, দায়সারা ও অল্প মাটি ফেলে বাঁধ সংস্কার করায় ছোট ঢলেই বাঁধ ভেঙে একের পর এক হাওড় তলিয়ে যাচ্ছে। 

কেউ কেউ বলছেন, সময়মতো বাঁধ তৈরি না করায় বাঁধগুলো টেকসই হয়নি। তাই বন্যার ধাক্কা সামলাতে পারেনি ফসল রক্ষা বাঁধগুলো। বাঁধের টাকা নয়-ছয় করতে বর্ষা এলে তড়িগড়ি করে বাঁধে মাটি ফেলা হয়। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও নড়বড়ে ফসল রক্ষা বাঁধের কারণে এবারও তারা নিঃস্ব হতে যাচ্ছেন। বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে পাউবোর প্রকৌশলীরা হাওড় ছেড়ে পালিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন কৃষকরা বাঁধ রক্ষায় মানববন্ধন করছেন। পাউবো শালস্না উপজেলা পানিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম যায়যায়দিনকে বলেন, যথাসময় বাঁধ সংস্কার করা হলেও বাঁধের মধ্যে থাকা কাঁকড়া ও ইঁদুরের গর্ত দিয়ে পানি ঢুকছে। এর জন্য পাউবো দায়ী নয়। বারবার বাঁধ ভাঙার জন্য ইঁদুর ও কাঁকড়া দায়ী। 

পাউবো কর্মকর্তাদের এমন হস্যকর যুক্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, কৃষকদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। শনির হাওড়কে বলা হয় বোরো ধানের ভান্ডার। বাঁধ ভেঙে যা তলিয়ে যাচ্ছে। এবার বাঁধের কাজ অনেক বিলম্বে শুরু হয়েছে। তাই যথাসময় কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করতে অনিয়ম হয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের কমিটিতে রাখা হয়নি। তাহিরপুরের কৃষক রফিক উদ্দিন বলেন, পিআইসিরা (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) দায়সারা কাজ করেছে। বাঁধের কাছ থেকে মাটি তুলে বাঁধ দিয়েছে। তাই বাঁধ ধসে গেছে। আগের ঠিকাদারি প্রথার মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। 

এখন পানি আসার পর বাঁধের কাজের গুরুত্ব বাড়ে। তাড়াহুড়া করে বাঁধের অর্থ ব্যয় হয়। যা সামান্য বন্যায় ভেসে যায়। অথচ আগে যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণের কাজ করলে হাওড়বাসীর কষ্টের ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হতো না। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। পিআইসির দুর্বল ফসল রক্ষা বাঁধের কারণে কৃষকদের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের দাবি করে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি। 'হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের' নেতারা বলছেন, শুধু উজানের ঢলের দোহাই দিলে চলবে না, ফসল ঝুঁকিতে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পরও বাঁধের কাজ শেষ করতে পারেনি পাউবো। 

মূল কাজ ফেলে রেখে প্রশাসন, পাউবোর কর্মকর্তারা কীভাবে একের পর একে প্রকল্প আর প্রাক্কলন ব্যয় বাড়ানো যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে কৃষকদের জন্য আবার বাঁচা মরার লড়াইয়ে পড়তে হচ্ছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেছে হাওড়াঞ্চলের বোরো ফসল। ফসল রক্ষায় প্রাণপণ লড়াই করছেন কৃষক। পানি বাড়তে থাকায় তারা ধান না পাকতেই কাটতে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষক আধা পাকা ধান ঘরে তুললেও ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। 

আর সপ্তাহ দেড়েক পরই পাকা ধান ঘরে তোলার কথা কৃষকদের। পাকা ধান ৭০-৮০ শতাংশ পেকেছে- এমন ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়ে মাইকিং করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত সুনামগঞ্জের সাতটি উপজেলার ফসল ডুবে গেছে। এর মধ্যে সদরে ১০০ হেক্টর, দোয়ারাবাজারে ২০ হেক্টর, তাহিরপুরে ১৫০ হেক্টর, ধর্মপাশায় ৫০০ হেক্টর, ছাতকে ৩০ হক্টর, দিরাইয়ে তিন হাজার ৬০০ হেক্টর এবং শালস্নায় ২০০ হেক্টর জমির ধান বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওড়ে এবার দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। 

এতে ১৩ লাখ টন খাদ্য উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। এখান থেকে ২২০ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদিত হওয়ার কথা। পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ফসলহানির পর একে একে তলিয়েছে অন্তত ১০টি হাওড়। বাঁধে ফাটল ধরায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে আরও ১০ হাওড়ের ফসল। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওড়, শনির হাওড়, সমসার হাওড়সহ সবকটি হাওড়ের ফসলই এখন ঝুঁকিতে আছে। জেলার জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই ও সালস্নায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে ফসল রক্ষা বাঁধে ধস ও ফাটল দেখা দিয়েছে। সময়মতো হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধ না হওয়ায় হাওড় এলাকার কৃষক সর্বনাশের মধ্যে পড়েছে। এই অঞ্চলের কৃষকের বড় পুঁজি বোরো ধান। 

শনির হাওড়ের কৃষক আসাদ মিয়া ও আব্দুল হাই জানান, এবার বাঁধে চাহিদা অনুযায়ী মাটি ফেলা হয়নি। ঠিকমতো কাজ হলে নদীর পানি হাওড়ে ঢোকার কথা নয়। বাঁধে ভালোভাবে মাটি ফেলা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালিপনার জন্যই তাদের এই দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ ফসল হাওড়ে ডুবেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ফসলডুবিতে হাওড় থেকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরেছিলেন কৃষকরা। তাই এবার শুরু থেকেই সেই আশঙ্কা করছেন কৃষক। পাউবো কর্মকর্তাদের কাছে বারবার ধরনা দিলেও তারা কর্র্ণপাত করেনি। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার হাওড়ে ৭২৭টি প্রকল্পে ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হয়েছে। এই বাঁধের নির্মাণকাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি। 

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, চেরাপুঞ্জির ব্যাপক বৃষ্টিতে ঢল নেমে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ২০১৭ সালের বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হাওড়াঞ্চল মানুষের ওপর পড়েছে, তা কখনো ঘুচিয়ে উঠতে পারেনি। ২০১৭ সালের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান। এ দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে আগামী ২৪-৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার প্রধান প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেতে পারে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2