avertisements 2

নতুন বাস ভাড়ায় পুরোনো নৈরাজ্য

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১২:১১ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

রাজধানীর গাবতলী থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। কিন্তু নিত ২৫ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ৪৫ পয়সা বেড়ে কিলোমিটারে বাসের ভাড়া হয়েছে দুই টাকা ১৫ পয়সা। এ হিসাবে মতিঝিল-গাবতলীর ভাড়া হবে ২৫ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। গতকাল সোমবার বাসের ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনে সরেজমিন 'ওয়েলকাম পরিবহন'কে এ ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে।

প্রথমে প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হন যাত্রীরা। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বললেন, আগেও বেশি ভাড়া নিত। ভাড়া বাড়ানোর পরও বেশি নিচ্ছে। ওয়েলকাম পরিবহনের পরিচালক নাবির হোসেন সমকালকে বলেন, তাদের বাস সিটিং হওয়ায় আগে ২৫ টাকা নেওয়া হতো। কিন্তু গতকাল রাত পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না পাওয়ায় প্রথম দিনে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। চালকের সহকারীরা অনুমানে ভাড়া নিচ্ছেন।

সরেজমিন নগর পরিবহন ও দূরপাল্লা উভয় রুটের বাসেই খেয়ালখুশিমতো ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। বাসের নতুন ভাড়া ঘোষণার পর নগর পরিবহনের চলা পুরোনো নৈরাজ্য আরও বেড়েছে।

ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা লিটার হওয়ায় ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে গত শুক্রবার ভোর থেকে সারাদেশে বাস বন্ধ করে দেন মালিকরা। কোটি কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েন। তিন দিনের মহাদুর্ভোগের ধর্মঘট শেষ হয় গত রোববার বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর। সে রাতেই ভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। কিন্তু এর ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত ভাড়ার তালিকা করতে পারেনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির সূত্র জানিয়েছে, করণিক ভুলে ভাড়ার তালিকা করা যায়নি। তালিকায় ভাগ চিহ্ন ভুলভাবে বসানো হয়েছে। তালিকা নতুন করে টাইপ করতে হচ্ছে। বিআরটিএ মুখপাত্র মাহবুব-ই রাব্বানী জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার তালিকা প্রকাশ করা হবে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের নগর পরিবহনের ভাড়া কিলোমিটারে ৪৫ পয়সা বেড়ে এক টাকা ৭০ থেকে দুই টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। মিনিবাসের ভাড়া এক টাকা ৬০ পয়সা থেকে দুই টাকা পাঁচ পয়সা হয়েছে। দূরপাল্লার ৫১ আসনের বাসের ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে এক টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়েনি।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিলে জনস্বার্থে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। মালিকরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।' তবে গতকাল রাজধানী কিংবা দূরপাল্লার পথে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থার তৎপরতা চোখে পড়েনি।

যেখানেই নামুক ভাড়া ৩৫ টাকা : 'আল মক্কা পরিবহনে' মহাখালী যেতে কাকরাইল থেকে ওঠেন বেসরকারি চাকরিজীবী শাহীন। তার কাছে ভাড়া দাবি করলে কথা কাটাকাটি হয় বাস কন্ডাক্টার ফিরোজের। পরে বাধ্য হয়ে শাহীনকে ৩৫ টাকাই দিতে হয়। শাহীন বলেন, সরকার ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ালে বাসে বেড়েছে ৫০ ভাগ। মতিঝিল থেকে মহাখালী পর্যন্ত যাত্রী যেখানেই নামুক ভাড়া ৩৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আগে এই ভাড়া নেওয়া হতো ২০ টাকা।

বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী, কাকরাইল থেকে মহাখালী পর্যন্ত ছয় দশমিক ৮ কিলোমিটার পথে আগের হিসাবে ভাড়া ছিল ১১ টাকা ৫৬ পয়সা। নতুন হিসাবে ভাড়া হবে ১৪ টাকা ৬২ পয়সা। মতিঝিল থেকে মহাখালীর ভাড়া হবে ১৮ টাকা। কিন্তু আগেই ছয় টাকা বেশি ভাড়া নিত 'আল মক্কা পরিবহন'। এখন ১৭ টাকা বেশি নিচ্ছে! তবে এ বিষয়ে পরিবহনটির কর্তৃপক্ষের কথা বলতে পারেনি সমকাল।

দূরপাল্লার বাসেও বেশি ভাড়া : গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনাল ঘুরে দূরপাল্লার বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও অসংগতি দেখা গেছে। ঢাকা থেকে সড়কপথে সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের দূরত্ব ৪২৪ কিলোমিটার। ৫১ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা হলেও ৪০ আসনের বাসে ভাড়া ছিল এক টাকা ৮১ পয়সা। এ হিসাবে ৪২৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া ছিল ৭৬৭ টাকা ৬৫ পয়সা। সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল যোগ হয়ে ভাড়া পড়ত ৭৯৯ টাকা। হানিফ পরিবহনের বাসে নেওয়া হতো ৮৫০ টাকা।

ভাড়া বাড়ানোর পর ৪০ আসনের বাসে ভাড়া হয়েছে কিলোমিটারে দুই টাকা ৩৪ পয়সা। ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে ভাড়া পড়বে ৯৯২ টাকা ১৬ পয়সা। বাসে আসনের ৭০ শতাংশ যাত্রী ধরে জনপ্রতি টোল ৩৫ টাকা ৭১ পয়সা। সব মিলিয়ে আদায়যোগ্য ভাড়া হবে এক হাজার ২৮ টাকা। হানিফ পরিবহনের বাসে নেওয়া হচ্ছে এক হাজার ৮০ টাকা।

একই চিত্র অন্যান্য বড় কোম্পানির বাসেও। তবে ছোট কোম্পানির লোকাল বাস যাত্রী ধরতে আগেও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম টাকা নিত। এখনও কমও নিচ্ছে। তবে এসব বাসে দাঁড়িয়ে, মোড়া পেতে যাত্রী তোলা হয়।

যেমন মহাখালী টার্মিনাল থেকে চলা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১১৬ কিলোমিটার পথে ৪০ আসনের বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ছিল ২১২ টাকা। কিন্তু লোকাল হিসেবে চলা 'সৌখিন পরিবহন' নিত ১৫০ টাকা। এখন নিচ্ছে ২০০ টাকা। কিলোমিটার প্রতি বর্ধিত হিসেবে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ভাড়া হবে ২৭১ টাকা। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর মালিকানাধীন এনা পরিবহন ২৭০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে।

ঢাকা-সিলেট রুটে শ্যামলী এনআর পরিবহনের বাসে ভাড়া ছিল ৪৭০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৬০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। ন্যাশনাল পরিবহন ঢাকা-রাজশাহী রুটের ভাড়া ৪৫০ থেকে ২৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৮০ টাকা নিচ্ছে। হানিফ পরিবহন ঢাকা-ঠাকুরগাঁও রুটের ৭৩২ টাকার ভাড়া ৩৬ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা নিচ্ছে।

কাউন্টারে টিকিটের জন্য মোশাররফ হোসেন নামে যাত্রী বলেন, 'হাজার টাকা ভাড়া লাগলে গরিব মানুষ বাড়ি যাবে কী করে?'
সিএনজিচালিত বাসও সুযোগ নিচ্ছে : ঢাকা শহরে যেসব সিএনজিচালিত বাস আছে, মোহাম্মদপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলা ৩৬ নম্বর বাস তার একটি। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া না বাড়লেও এ বাসে জিগাতলা থেকে প্রেস ক্লাবের ভাড়া পাঁচ টাকা ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

যাত্রীরা বলছেন, কোন বাস সিএনজিতে চলে আর কোন বাস ডিজেলে চলে, কীভাবে বুঝব? গাবতলী রুটের একটি বাসে গতকাল পল্টনে এ নিয়ে ফার্মগেটগামী এক যাত্রীর সঙ্গে কন্ডাক্টারের কথা কাটাকাটি হয়। যাত্রী বলেন, 'তোমাদের বাস না গ্যাসে চলে?' কন্ডাক্টর বলেন, 'সিলিন্ডার খুঁজে দেখেন, গ্যাসে না তেলে চলে।' গ্যাসচালিত টেম্পো/লেগুনাগুলোতেও বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নগর পরিবহনে নৈরাজ্য বেশি :গাবতলী রুটের ৮ নম্বর বাসে মতিঝিল থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। আগে এই ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। বিকল্প পরিবহনে মতিঝিল থেকে মিরপুর-১২ এর ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। গতকাল নেওয়া হয়েছে ৩৫ টাকা। মিডওয়ে পরিবহনে মতিঝিল থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত ভাড়া ছিল ১০ টাকা; নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। মোহাম্মদপুর পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। বিহঙ্গ পরিবহনের এক কর্মী সমকালকে জানান, মালিকের বেঁধে দেওয়া হারেই তারা ভাড়া কাটছেন। কিন্তু যাত্রীর তা মানতে চাইছে না। সারা পথ ঝগড়া করতে হচ্ছে।

মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে সাভার পর্যন্ত 'ইতিহাস পরিবহন'-এ আগে ভাড়া ছিল ৩০ টাকা, গতকাল নেওয়া হয়েছে ৪৫ টাকা। ইতিহাস পরিবহনের একজন কর্মী জানান, মালিক ১৬ টাকার ভাড়া ২০ টাকা আর ২৪ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা নিতে বলেছে।
যাত্রীদের মতো যাত্রী কল্যাণ সমিতিও অভিযোগ করেছে, আগেও বেশি ভাড়া নেওয়া হতো বাসে। ২৭ ভাগ ভাড়া বাড়ানো পরও বেশি নেওয়া হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস ভাড়া আরও বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু সরকার যতটুকু বৃদ্ধি করেছে মালিকরা তা মেনে নিয়েছেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলতে হবে। এর বেশি নিলে ব্যবস্থা নেবে সমিতি।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, এত হৈ চৈ করে ভাড়া নির্ধারণ ও তালিকা করা হয়েছে- এতে লাভ কী? আগেও কেউ তালিকা মেনে ভাড়া নেয়নি। এখনও নিচ্ছে না। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না থাকায়, এবারও তালিকা মেনে ভাড়া আদায় হবে না।

তিনি বলেন, গণপরিবহনে আগে শৃঙ্খলা দরকার। এত বিশৃঙ্খল ও অপেশাদার গণপরিবহন কোথাও নেই। সরকার বলে, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। তাই আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা হয় না। কিন্তু শহরে সিটিং সার্ভিস চলছে। তার ভাড়া কে ঠিক করবে? এসি বাস চলছে কিন্তু ভাড়ার তালিকা নেই। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকলে যে যার মতো ভাড়া নেবে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2