জন্মনিবন্ধনের গ্যাঁড়াকলে শিশুর টিকা!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১০:০৬ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
গত ১ নভেম্বর থেকে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর অবশ্যই ১৭ ডিজিটের অনলাইনে করা জন্মনিবন্ধন সনদ থাকতে হবে। তাছাড়া কেউ অন্য কোনোভাবে টিকা নিতে পারবে না। হাতে লেখা কিংবা ১৭ ডিজিটের কম সংখ্যার জন্মসনদ দিয়ে টিকা গ্রহণের জন্য নিবন্ধন করা যাবে না। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, এ গ্যাঁড়াকলে পড়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী সময়মতো টিকা নিতে পারবে না।
কেননা, শিক্ষার্থীদের অনেকে স্কুলে ভর্তির সময় ম্যানুয়াল জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দিয়েছে। আবার কারও কারও জন্মসনদ নম্বর ১৭ ডিজিটের কম। এছাড়া ২০১৩ সালের আগে নিবন্ধিত অনেক জন্মসনদ ১৭ ডিজিটের হলেও তা অনলাইনে নেই। এ ধরনের সনদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও তা সংশোধন করতে যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে, ম্যানুয়াল জন্মনিবন্ধন সনদ অনলাইনে অন্তর্ভুক্তি করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ।
অনলাইন-বহির্ভূত এসব জন্মনিবন্ধন এখন হুবহু একই জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই। তবে যে এলাকায় হাতে লেখা জন্মনিবন্ধনটি করা ছিল, সেই কার্যালয়ে রক্ষিত বইতে সনদের তথ্য পাওয়া গেলে নিবন্ধক সরাসরি হাতে লেখা সনদের তথ্য দিয়েই অনলাইন নিবন্ধন করে দিতে পারবে।
তবে এ ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন নম্বরটি পরিবর্তিত হবে। অথচ বিপুল সংখ্যক অভিভাবক সন্তান জন্মের সময় তার তৎকালীন কর্মস্থল থেকে কিংবা গ্রাম থেকে ম্যানুয়াল সনদ সংগ্রহ করেছেন। যাদের অনেকের সঙ্গে ওই এলাকার বর্তমানে কোনো যোগাযোগ নেই। আবার অনেক কার্যালয়ে দীর্ঘদিন আগের জন্মনিবন্ধন বই সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে তাদের পক্ষে সেখান থেকে ডিজিটাল সনদ সংগ্রহ করা কঠিন।
অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পরিবর্তিত নতুন নিয়মে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করা মারাত্মকভাবে জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে আগে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন করতে হবে। যদিও এর আগে মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়েই যে কারও জন্মনিবন্ধন \হকরা যেত। তবে নতুন নিয়মে তা কোনোভাবেই করা যাচ্ছে না। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করার আগে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে।
এতে রাজধানীতে চলমান স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বাদ পড়বে। অন্যদিকে, স্কুল-কলেজে শুরু হলেও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টিকাদানের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। অথচ এই শিক্ষার্থী সংখ্যাও বিপুল। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকার ৬৯টি মাদ্রাসা থেকে ১২-১৭ বছর বয়সি ১২ হাজার ৩৫৪ শিক্ষার্থীর তথ্য অধিদপ্তরের কাছে এসেছে। তারা সেগুলো আইসিটি বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে ঢাকার বাইরে ৬৪ জেলার মধ্যে তথ্য এসেছে মাত্র ৩৪ জেলার।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের এখনো টিকার তারিখ হয়নি বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কে এম রুহুল আমিন। অথচ টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী। ১৪ নভেম্বর পরীক্ষা শুরুর আগে এ স্তরের শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম শেষ করার চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি।
তবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এসএসসির সমমান মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার্থীদের টিকার কী ব্যবস্থা হবে এ বিষয়টি এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত। এদিকে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি যেকোনোভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও লেখাপড়ার বাইরে থাকা এ বয়সি শিশুর টিকা কোনো প্রক্রিয়ায় দেওয়া হবে তা নিয়ে ভয়াবহ জটিলতা দেখা দিয়েছে।
কেননা এ শ্রেণির সিংহভাগ শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। সুতরাং তাদের কিসের ভিত্তিতে নিবন্ধন করে টিকা দেওয়া হবে তার সমাধান করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। তাই এ ব্যাপারে পথ খুঁজে বের করতে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, লেখাপড়ার বাইরে থাকা ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদেরও টিকার আওতায় আনা হবে। তবে তাদের টিকা কবে থেকে কীভাবে দেওয়া হবে সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যেহেতু তাদের বেশির ভাগেরই জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। তাই তাদের তা সম্পন্ন করে টিকা দেওয়া হবে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জাতীয় কারিগরি কমিটির পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।
তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'যেসব শিশু স্কুলে যায় না, তাদেরও টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ফাইজারের টিকা আছে, পাইপলাইনে আরও আছে। সারাদেশে সব শিশুকে টিকা দিতে তিন কোটি টিকা প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থীও টিকার বাইরে থাকবে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত টিকাও এ মুহূর্তে সরকারের হাতে নেই। ফাইজার-বায়োএনটেকের ৭০ লাখের বেশি ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর পুরোটাই এসেছে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে। এ মাসেই ফাইজারের আরও ৩৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাকি প্রায় ২ কোটি টিকা কবে কোথা থেকে আসবে তার কোনো শিডিউল এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে টিকা নিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি লেখাপড়ার বাইরে থাকা শিশুদের অভিভাবকরা সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এ সুযোগে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখার একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দুই হাতে উপরি আদায় করছে। ভুক্তভোগীরা জানান, যেসব আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়, সেখানে দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিটি জন্মনিবন্ধন সনদ করতে তারা দেড় থেকে দুই হাজার টাকা নিচ্ছে। জরুরি সনদ নেওয়ার জন্য দালালরা কেউ কেউ তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দাবি করছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তিলপা পাড়া কার্যালয়ে এ দুর্নীতি ভয়াবহ বলে ভুক্তভোগীরা অনেকেই অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা একদিকে জন্মনিবন্ধনের নতুন নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন, অন্যদিকে ভুলে ভরা জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট অফিসে দিনের পর দিন ঘুরেও সেই জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে পারছেন না।