ভুতুড়ে ফ্লাইওভার ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্র
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:২২ পিএম, ৮ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:২৬ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
উদ্বোধনের পর থেকেই অন্ধকারে ঢাকার মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইওভারটিতে আলো না জ্বলাতে অপরাধী চক্র রয়েছে সক্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। সূর্যের আলো নিভে গেলেই ফ্লাইওভারটিতে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। আর গভীর রাতে ফ্লাইওভারটি রীতিমতো ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত ১১টার পরে ছিনতাইকারীর ভয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে যানবাহন চলাচল করে না। যারা না জেনে গভীর রাতে ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করে তাদের বিপদে পড়তে হয়।
শুধু তাই নয় ভুতুড়ে পরিবেশের কারণে অনেক যানবাহনই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
আলো না থাকার কারণে মাদকসেবীরা নির্বিঘ্নে মাদক সেবন করে। এমনকি ফ্লাইওভার থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, রাতের বেলা ফ্লাইওভারে আলো না থাকায় কিছু দুর্বৃত্ত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চুরি-ছিনতাই করছে। আরেকটি চক্র সুতা দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে লুটে নিচ্ছে টাকা, মোবাইল, ল্যাপটপসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী। ছিনতাইকারীর ফাঁদে পড়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর ফাঁদে পড়ে সবকিছু হারানোর পরও ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করে না।
সূত্র জানিয়েছে, রাতে মোটরসাইকেল আরোহীদের সুতার ফাঁদে ফেলে সবকিছু লুটে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। ফ্লাইওভারে চলাচলের রাস্তায় আড়াআড়িভাবে নাইলনের সুতা বেঁধে রাখে চক্রটি। মোটরসাইকেল আরোহীরা দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করলে সুতায় টান লেগে আটকে যান। আর মোটরসাইকেল থামালেই সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা এসে হাজির হয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। গভীর রাতে যানবাহন ও মানুষ চলাচল না থাকায় ভুক্তভোগীর কিছু করার থাকে না। গত ১০ই জুলাই ফ্লাইওভারের মগবাজার অংশে বেঁধে রাখা সুতার ফাঁদে পড়ে সবকিছু হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানভির জোবায়ের। তার পরেরদিন সোনারগাঁও অংশে একই ঘটনার শিকার হন সাংবাদিক মোহাম্মদ হোসাইন তারেক।
শুধু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে নয়, আলো না থাকায় এমন ফাঁদ পেতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঢাকার অন্যান্য ফ্লাইওভারে আছে। ১২ই আগস্ট কুড়িল ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর ফাঁদে পড়েন শেখ রায়হান কবির নামের এক ব্যক্তি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে সুতা পার্টির ফাঁদে পড়ে গলায় মারাত্মক আঘাত পান মাহমুদ রেজা তফুর। ১৫ই ডিসেম্বর কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গলায় গামছা প্যাঁচানো এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ৫ই জানুয়ারি রাত ১টার দিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সোনারগাঁও হোটেল অংশ থেকে মিজানুর রহমান নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছিল বলে তখন পুলিশ জানিয়েছিল।
সরজমিন দেখা গেছে, ফ্লাইওভারটির হলি ফ্যামিলি থেকে সাতরাস্তা, ইস্কাটন থেকে ওয়্যারলেস মোড়, আবুল হোটেল থেকে শান্তিনগর-রাজারবাগ, শান্তিনগর থেকে ইস্কাটন, মৌচাক থেকে শান্তিনগর- রাজারবাগ বিস্তৃত ফ্লাইওভারের কোথাও আলো জ্বলে না। বাতি লাগানোর স্ট্যান্ড আছে, বাতিও আছে কিন্তু আলো জ্বলে না। বেশির ভাগ স্থানেই বিদ্যুতের তার, বক্স সবই চুরি হয়ে গেছে। ফলে ফ্লাইওভারের ওপর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। রাতের বেলা হেড লাইটের আলো দিয়েই যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের পাশের উঁচু ভবনের মিটমিট আলোর ওপর ভরসা করেই যানবাহন ও অনেক সময় মানুষ চলাচল করে। সরজমিন আরো দেখা গেছে ফ্লাইওভারের সমতল স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খালি ফেনসিডিলের বোতল।
সিএনজিচালক আলম মিয়া বলেন, সর্বোচ্চ রাত ১১টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করে। এরপরে আর কেউ সাহস করে ফ্লাইওভার দিয়ে যায় না। কারণ অন্ধকারের মধ্যে ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। যানবাহন চলাচল কম থাকায় নির্বিঘ্নে ছিনতাইকারীরা সব নিয়ে চলে যায়। বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী শাহাদাত হোসেন বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত ফ্লাইওভারের কয়েকটি অংশে প্রেমিক-প্রেমিকা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আড্ডা দেয়। কিন্তু গভীর রাতে ছিনতাইকারী মাদকসেবীর দখলে চলে যায়। যারা মাদকাসক্ত তারাই ছিনতাই করে।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত ফ্লাইওভারটি ২০১৭ সালের ২৬শে অক্টোবর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। চার লেনের এই ফ্লাইওভারে ওঠানামার জন্য সাতরাস্তা, সোনারগাঁও, হলি ফ্যামিলি, বাংলা মোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, শান্তিনগর মোড়, আবুল হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে ১৫টি র্যাম্প। ফ্লাইওভারের মগবাজার রেলক্রসিং থেকে সাতরাস্তা এবং সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত অংশটুকুর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি)। আর বাকি অংশটুকুর দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর দীর্ঘদিন অভিভাবকহীন ছিল মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাকে এই দায়িত্ব দেয়া হবে সেটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। পরে ২০১৮ সালের ৮ই নভেম্বর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ফ্লাইওভারটির দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দায়িত্ব দেয়ার পর সিটি করপোরেশনকে বাতি লাগানোর কোনো বাজেট দেয়া হয়নি। তাই বাতি লাগানো নিয়ে অনেক গড়িমসি হয়। পরে ডিএসসিসি বাতি লাগানোর জন্য একটি বাজেট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় ২৪ কোটি টাকা বাজেটের সত্তর শতাংশ দিতে রাজি হয়। বাকি টাকা ডিএসসিসিকে বহন করতে বলে। এখন ডিএসসিসি’র মেয়রের দপ্তরে ফাইলটি পড়ে আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, বাতি লাগানোর কাজ কবে শুরু হবে সেটি এখনো ঠিক হয়নি। তবে ফ্লাইওভারে বাতি লাগানোর যাবতীয় খরচের একটি বাজেট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। মন্ত্রণালয় সেই বাজেটের ৭০ শতাংশ দিতে রাজি হয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশ ডিএসসিসিকে দিতে বলেছেন। এখন ফাইলটি মেয়রের কাছে আছে। তিনিই সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে বাজেটের পুরো টাকা ডিএসসিসি দিবে এমন সিদ্ধান্তও হতে পারে। ফ্লাইওভারের উদ্বোধনের পরে বাতি লাগাতে এতো দেরি হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের দায়িত্ব অনেক পরে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপরে এটার বাজেট রেডি করে মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়। সেখান থেকে বাজেট পাস হতেও কিছুটা সময় লেগেছে।