avertisements 2

ধ্বংসস্তূপের নিচে একজন মানুষ কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে?

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:৩৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

তুরস্ক ও সিরিয়ায় সোমবারের ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর এখনো যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, তাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় উদ্ধারের সময় ক্রমশই ফুরিয়ে আসছে। এই দুটি দেশসহ সারা বিশ্বের উদ্ধার কর্মীরা, যেখানেই কারো বেঁচে থাকার সামান্য চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই খুব দ্রুত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে তার নিচ থেকে লোকজনকে বের করে আনার জন্য বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এরকম ধ্বংসস্তূপের নিচে একজন মানুষ ঠিক কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। ভবনটি যখন ধসে পড়ে তখন তার অবস্থান কোথায় ছিল, তিনি যেখানে চাপা পড়ে আছেন সেখানে বাতাস ও পানি আছে কি না, সেখানকার জলবায়ু, আবহাওয়ার অবস্থা এবং ওই ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতা এসবের ওপরেই নির্ভর করে ওই ব্যক্তি কতক্ষণ সেখানে বেঁচে থাকতে পারবেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্যোগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু এর চেয়ে আরো বহু সময় পরেও ধ্বসংস্তূপের নিচ থেকে লোকজনকে জীবন্ত অবস্থায় উদ্ধারের নজির রয়েছে।

সাধারণত দেখা গেছে বিপর্যয়ের পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যে জাতিসঙ্ঘ উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। প্রথম কিম্বা দ্বিতীয় দিনে কাউকে জীবন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব না হলেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এ রকম পরিস্থিতিতে ধ্বংসস্তূপের নিচে একজনের বেঁচে থাকার জন্য কোন কোন বিষয় জরুরি?

সচেতনতা ও প্রস্তুতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প কখন হবে অথবা একটি ভবন কখন হঠাৎ করে ধসে পড়বে সেটা আগে থেকে অনুমান করা সহজ নয়। কিন্তু তার পরেও এ রকম জরুরি পরিস্থিতিতে আপনি কোন জায়গায় অবস্থান নিবেন বেঁচে থাকার জন্য সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি ভাল জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে অবস্থান করতে পারলে শারীরিকভাবে যেমন নিরাপদ থাকা যাবে তেমনি সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো বাতাসও থাকতে পারে।

তুরস্কে একটি উদ্ধারকারী সমিতির সমন্বয়কারী মুরাত হারুন অনগোরেন বলেন, ‘এই কৌশলকে বলা হয় ড্রপ, কভার অ্যান্ড হোল্ড। যেখানে বাতাস আসতে পারে সেরকম একটি জায়গায় আশ্রয় নিলে সেটি হবে বেঁচে থাকার জন্য উপযোগী পরিবেশ।’

তিনি বলেন,‘ড্রপ, কভার অ্যান্ড হোল্ড’ কথাটির অর্থ হচ্ছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ুন, টেবিল অথবা এরকম কোনো জিনিসের নিচে আশ্রয় নিন এবং ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত কিছু একটা শক্ত করে ধরে রাখুন।

‘জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সেবিষয়ে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা (ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের আগে) খুব গুরুত্বপূর্ণ যা প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।’

‘ধ্বংসস্তূপের নিচে আপনি কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবেন এসব বিষয়ের ওপর সেটা নির্ভর করবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির টেকনিক্যাল অফিসার ড. জেতরি রেগমিও এধরনের প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘শক্ত একটি ডেস্ক কিম্বা টেবিলের নিচে এ রকম নিরাপদ একটি স্থানে আশ্রয় নিলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এখানে কোনো কিছুর নিশ্চয়তা নেই। কারণ প্রত্যেকটি জরুরি অবস্থা আলাদা ধরনের। তবে উদ্ধারকাজ প্রাথমিকভাবে কতটা সফল হবে সেটা নির্ভর করে এ বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের সচেতনতা ও প্রস্তুতির ওপর।’

পানি ও বাতাস
ধসে পড়া একটি ভবনের নিচে আটকে থাকা অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য সেখানে বাতাস ও পানির সরবরাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এটা আপনি কতোটুকু আহত হয়েছেন তার ওপর। যদি প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ যদি গুরুতরভাবে জখম না হয়, এবং সেখানে নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য বাতাস থাকে, তাহলে তাকে এরপরেই যেটা চেষ্টা করতে হবে তা হলো তার শরীরে যাতে যথেষ্ট পানি থাকে।

নিবিড় যত্ন বিষয়ক গবেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এডওয়ার্ড মুন বলেন, ‘পানি ও অক্সিজেনের অভাবে বেঁচে থাকার কঠিন হয়ে পড়তে পারে।’

তিনি বলেন, ‘একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীর থেকে প্রতিদিন ১.২ লিটার পানি বের হয়ে যায়।’

‘মূত্রত্যাগ, নিঃশ্বাসের সাথে বাষ্প এবং ঘামের মাধ্যমে পানি বের হয়ে যায়। একজন মানুষের শরীর থেকে যখন আট লিটার পানি বের হয়ে যায় তখন সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।’

কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পানি ছাড়া মানুষ তিন থেকে সাতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

জখমের মাত্রা
একজন ব্যক্তি যখন মাথায় আঘাত পান, অথবা গুরুতরভাবে আহত হন, এবং নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকে না, তখন তার দুর্যোগের একদিন পর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে।

এ কারণে ওই ব্যক্তি কতটুকু আহত হয়েছেন সেটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ড. রেগমি।

তিনি বলেন, ‘যারা মেরুদণ্ড, মাথায় অথবা বুকে আঘাত পান তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া না হলে তারা নাও বেঁচে থাকতে পারেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তক্ষরণ, হাড় ভেঙে যাওয়া অথবা কোনো অঙ্গ গভীরভাবে কেটে গেলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

ড. রেগমির মতে উদ্ধার করার পরে তাকে কীভাবে যত্ন করা হচ্ছে বা কী ধরনের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘ধ্বসংস্তুপের নিচ থেকে উদ্ধার করার পরেও ক্রাশ সিনড্রোমের কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের ঘটনায় তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যান।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা বলছেন, ধ্বংসস্তূপের চাপের কারণে যাদের দেহের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং টক্সিন উৎপন্ন হয় তাদেরই এই ‘ক্রাশ সিনড্রোম’ দেখা দেয়। যখন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলা হয় তখন সেই টক্সিন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর।

জলবায়ু এবং আবহাওয়া
ধ্বংসস্তূপের নিচে একজন মানুষ কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবেন সেটা তিনি যেখানে আটকা পড়ে আছেন সেখানকার জলবায়ুর ওপরেও নির্ভরশীল।

অধ্যাপক মুন বলছেন, প্রচণ্ড ঠান্ডা তুরস্কের পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ সাধারণত সর্বনিম্ন ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত তার শরীরের উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে। কিন্তু ঠান্ডা অবস্থায় পরিস্থিতি হয় অন্য রকমের।’

এই অবস্থায় মানুষের দেহের তাপমাত্রা সেখানকার তাপমাত্রা অনুযায়ী কাজ করে।
তিনি বলেন, ‘কতো দ্রুত হাইপোথার্মিয়া (শরীরের অত্যধিক নিচু তাপমাত্রা) হবে সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তি কতোটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন তার ওপর, অথবা তিনি কতটুকু আশ্রয় পাচ্ছেন তার ওপর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে এই পরিস্থিতিতে অনেকের দেহের তাপমাত্রাই অনেক বেশি কমে যায়।’

কিন্তু গ্রীষ্মকালে এরকম হলে, যে জায়গায় তিনি আটকা পড়ে আছেন সেখানে যদি খুব বেশি গরম থাকে, তাহলে তার শরীর থেকে খুব দ্রুত পানি বের হয়ে যেতে পারে, ফলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে।

মানসিক শক্তি
ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানসিক শক্তি ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিষয়টির ওপর খুব কমই জোর দেয়া হয়ে থাকে।

তারা বলছেন, এরকম পরিস্থিতিতে কারো মানসিক শক্তি তীব্র হলে সেটা তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।

উদ্ধারকাজ বিশেষজ্ঞ অনগোরেন বলেন,‘ভয় পাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের আতঙ্কিত হওয়া চলবে না। মানসিকভাবে আমাদের শক্ত থাকতে হবে যাতে আমরা বেঁচে থাকতে পারি।’ এজন্য দরকার মনোবল বা দৃঢ়-সংকল্প।

‘ভয় দূর করা এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমি এখানে ঠিক আছি, বেঁচে থাকার জন্য আমাকে কিছু উপায় খুঁজে বের করতে হবে’ এ ধরনের মানসিকতা প্রয়োজন। তখনই সে কম চিৎকার করবে এবং শারীরিকভাবেও কম নড়াচড়া করবে। নিজের অনুভূতি আর ভীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে দেহের শক্তি জমা রাখতে হবে।’

নাটকীয় কিছু উদ্ধারের কাহিনি
দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৯৫ সালের এক ভূমিকম্পের ১০ দিন পর এক ব্যক্তিকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বৃষ্টির পানি পান করে এবং একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স খেয়ে তিনি এতদিন বেঁচে ছিলেন বলে জানা গেছে। মানসিকভাবে শক্ত থাকার জন্য এ সময় তিনি একটি শিশুর খেলনা নিয়ে খেলেছেন।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালের মে মাসে রানা প্লাজা ধসে পড়ার ১৭ দিন পর ওই কারখানার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে রেশমা নামের একজন নারী উদ্ধার করা হয়েছিল।

উদ্ধারের পর তিনি বলেছিলেন,‘কয়েকদিন ধরে আমি উদ্ধার কর্মীদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমি লাঠি আর রড দিয়ে ধ্বংসস্তূপে বাড়ি দিতাম। তাদের কেউই আমাকে শুনতে পাননি।’

রেশমাকে উদ্ধারের ওপর 'রানা প্লাজা' নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

‘১৫ দিন ধরে আমি শুকনো খাবার খেয়েছি। শেষ দু'দিনে আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছু ছিলো না।’

হেইতিতে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের ভূমিকম্পের ১২ দিন পর এক ব্যক্তিকে একটি দোকানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।

পরে আরো এক ব্যক্তিকে ভূমিকম্পের ২৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বলে খবরে জানা গেছে।

পাকিস্তানের কাশ্মীরে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে ভূমিকম্পের দু‘মাস পর ৪০ বছর বয়সী এক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তার নাম নাকসা বিবি। তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল তার বাড়ির রান্নাঘর থেকে। তার শরীরের পেশি শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে হাঁটতেও পারতেন না।

পরে এক সাক্ষাতকারে তার একজন আত্মীয় বলেছিলেন, ‘আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন। কিন্তু আমরা যখন তাকে টেনে বের করছিলাম তখন তিনি তার চোখ খুললে বুঝতে পারি যে তিনি বেঁচে আছেন।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2