দরিদ্র কৃষকের মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে স্বপ্ন পূরণ করলেন বাবার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:৪৬ পিএম, ৯ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:১১ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এক দরিদ্র কৃষক কন্যা’র বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হওয়ার বাস্তব গল্প…… (গল্পটা একটু লম্বা ধৈর্য সহকারে সম্পুর্ণটা পড়ার অনুরোধ রাখছি। আশা করি সময়টা বিফলে যাবে না।) ফরিদা সুলতানা সোনালি আমার অনার্স লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ডদের একজন। ওর বাবা হয়তো ওর নাম সোনালি রেখেছিলেন ওর সোনালি ভবিষৎ এর কথা ভেবেই। কারন তিন পুত্রের পর ১ম কন্যা যদিও তারপরে আরো ২ মেয়ে ও ১ ছেলে আসে সংসারে।
তবুও ৩ ভাইয়ের পর ১ম কন্যা সন্তান আবার পরিবারের বড় মেয়ে।(সংসারের বড় মে’য়ের জন্য বাবাদের আ”লাদা ভালোবাসা থাকে এটা আমি আমার পরিবারেও দেখেছি) তো সোনালি সেই দরিদ্র কৃষক বাবার ১ম রাজকন্যা না কৃষককন্যা। উত্তরের জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম লেংগাবাজারের আর ‘৫ টা মেয়ের মত বড় হতে লাগল সে। ইতিমধ্যে মায়ের হাতে পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়ে গেল। কারন সোনালির নানা গোষ্ঠীর সবাই প্রায় উচ্চ’শিক্ষিত সেই সুত্রে ওর মা মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন এরপরে বিয়ে হয়ে যায়। ওর যখন স্কুলে যাবার বয়স হল গ্রামে তখন ব্রাক এনজিও পরিচালিত বিনামুল্যে স্কুল সামগ্রীসহ ব্রাক স্কুল প্রো’গাম চলছিল।
তো সোনালির বাবা মেয়েকে সেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে মূলত গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ত। সেই ব্রাক স্কুল থেকেই সে প্রাথমিকের পাঠ সমাপ্ত করে। মজার বিষয় হল সেই স্কুলের সোনালির অন্যান্য সহপাঠী গণ আর কেউই মাধ্যমিক পাস করতে পারেনি। সহপাঠিনীদের তো প্রায় সবার মাধ্যমিক পাসের আগেই বিয়েই হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক শেষ করে ও ভর্তি হয় লেংগাবাজারবি.এস হাইস্কুলে।তবে, ততদিনে ওর পরিবারে নেমে এসেছে এক অশনিসংকেত। ওর বাবার হার্টের অসুখ ধরা পরে ২০০০ সালে অর্থ্যাৎ ও যখন প্রাথমিকের শেষ পর্যায়ে। তবুও ওর বাবা মা মেয়ের পড়ালেখায় আগ্রহ দেখে পড়ালেখা চালিয়ে যান। এরপর ২০০৪ সাল ও তখন নবম শ্রেনির ছাত্রী মরার উপর খরার ঘা এর মত নেমে আসে আরেক বিপদ।ওর মা প্যারালাইজড হয়ে যান। এতে করে সংসারের বড় মেয়ে হিসেবে সাংসারিক সব কাজ ওকেই করত হত। সংসারের কাজ + পড়ালেখা দুটোই চালিয়ে যায় সোনালি।
এভাবে সংগ্রাম করে পড়ালেখা করে ও ৪.৯৪ পয়েন্ট নিয়ে ২০০৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ হতে মাধ্যমিক পাস করে। এসএসসি পাস করে ভর্তি হয় ধর্মপুর আব্দুল জব্বার ডিগ্রী কলেজে। আর গ্রামের মেয়ে কলেজে পড়ে মানে সে বড় হয়ে গেছে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। তখন পারিবারিকভাবে সোনালি একই গ্রামের কৃষক সন্তান মোশাররফ হোসাইনকে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার শর্ত দিয়ে বিয়েতে রাজি হয়। এভাবে ইন্টার ১ম বর্ষেই বিয়ে হয় সোনালি ও মোশাররফ ভাইয়ের। শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের বিবাহিত জীবন। অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে সোনালি শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করে।তবে সেই স্বপ্ন ভাঙ্গতে সময় লাগে না।
ছোট্ট সেই মেয়েটা সংসারের কি বোঝে! ভয় আর দ্বিধা নিয়ে শুরু হল সংসার জীবন। স্বামী পড়ালেখা করাতে রাজি থাকলেও স্বামীর পরিবারের সদস্যরা বেকেঁ বসলেন তারা পরিবারের বউকে পড়ালেখা করাবেন না সাফ জানিয়ে দিলেন। তখন ওর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল। আর এ কথা শুনে সোনালির বাবা ক্ষেপে গেলেন বললেন সংসার করতে হবেনা তুই পড়ালেখা কর। কিন্তুু সোনালি যে হেরে যাবার পাত্রীই না তাই সে সংসার ছাড়তে রাজি হল না। কারন আমাদের সমাজে ডির্ভোসি মেয়েদেরকে অসন্মান করা হয় পদে পদে ( আমি এই বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী)। তবে পড়ালেখাও চালিয়ে যাবার পণ থাকল অটুট। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কাজ না করে পড়ালেখা করলে জুটবে না প্রতিদিনকার আহার। শুরু হল নতুন এক যুদ্ধ। মাঝে মাঝে দুই/তিন দিন শুধু পানি খেয়ে কাটিয়ে দিত সে। প্রতিবেশীরা এসব জানতে পেরে ওর শ্বশুরাড়ির লোকদের নজর এড়িয়ে মধ্যরাতে এক বাটি খাবার দিয়ে যেত।
তাই দিয়ে হত ক্ষুধা নিবারন।আবার ভোর হবার আগেই তারা সেই বাটি ফেরত নিয়ে যেত। সেই সময়ে ওর স্বামীর সংসারে আয় না থাকায় ওকে মানসিক সাপোর্ট দিলেও এসব বিষয়ে কিছুই করতে পারতেন না। এভাবেই কঠিন সংগ্রামের সংসার করে সোনালি বিজ্ঞান বিভাগ হতে ৪.৪০ পয়েন্ট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। এরপরে কোনপ্রকার কোচিং প্রাইভেটে না পড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে জয় লাভ করে ও। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ যদিও হয়নি । তবুও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। তখন শ্বশুর বাড়ি হতে কোনভাবেই ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দেওয়া হয় না।