রাশেদুল ইসলাম
ক্ষমতা মানেই ক্ষমতাহীনতা (শেষাংশ)
প্রকাশ: ১২:২২ এএম, ৭ নভেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:১৮ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
প্রেম অন্ধ । প্রেমকে অন্ধ বলা হয় এই কারণে যে, একজন চক্ষুষ্মান মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যা না করে, একজন প্রেমেপড়া মানুষ তাই করে । ‘তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটি বলতেই একজন প্রেমিকের গলা শুকিয়ে আসে, প্রচণ্ড শীতের মাঝেও দর দর করে ঘামতে থাকে সে । নির্জন জায়গায় একজন প্রেমিক অবলীলায় মশার কামড় খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারে । অথচ, স্বাভাবিক অবস্থায় এ সবের কোনটাই পারে না সে । আবার ক্ষমতার দম্ভও মানুষকে অন্ধ করে । একজন ক্ষমতায় অন্ধ মানুষ বয়োবৃদ্ধ একজন মানুষকে সকলের সামনে ঠাস ঠাস করে গালে চড় মারতে পারে । সুন্দরী কোন মেয়েকে প্রকাশ্য রাস্তায় গায়ে হাত দিতে পারে সে । অথচ, একজন স্বাভাবিক মানুষ এসবের কিছুই করতে পারে না । এখন প্রশ্ন হতে পারে, ক্ষমতার দম্ভ কি ?
এক কথায় উত্তর দিলে বলতে হয়, ক্ষমতার বদহজমের নামই ক্ষমতার দম্ভ । ক্ষমতার নিজস্ব একটা উত্তাপ থাকে। গরম থাকে । ক্ষমতাবান অনেকেই সেই উত্তাপ বা গরম সহ্য করতে পারে না । তখন তা তার শরীরে এক ধরণের বদহজম তৈরি করে । এই বদহজম প্রকাশের নামই ক্ষমতার দম্ভ ।
অনেক কারণেই একজন মানুষ ক্ষমতাবান হতে পারে । তবে যে কারণেই ক্ষমতাবান হোক না কেন , ক্ষমতা প্রথমত মানুষকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে । হঠাৎ একজন যখন টাকার মালিক হয়, তখন সেই টাকা তাকে ক্ষমতাবান করে । টাকার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান একজন মানুষ যাদের টাকা নেই, বা তার তুলনায় কম টাকা আছে, তাদেরকে সে নিকৃষ্ট ভাবে । শারীরিক শক্তির দিক দিয়ে যে বেশী বলবান, সে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষদের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর মনে করে । অস্ত্রধারী একজন মানুষ নিরস্ত্র মানুষকে নিকৃষ্ট ভাবে । নীতিনির্ধারণ বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইংরেজদের সর্বোত্তম বিবেচনা করা হয় । অস্ত্রধারী এবং নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ব্রিটিশ আইনে অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি । অস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নিরস্ত্র ব্যক্তিদের ( যেমন একজন ম্যাজিস্ট্রেট) । আবার নিরস্ত্র ব্যক্তিকে অস্ত্র রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি । যেসব দেশ ব্রিটিশ প্রবর্তিত এই নিয়মের বাইরে গেছে, তারাই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সমস্যায় পড়েছে ।
একটি কল্পিত আদর্শ সমাজ ব্যবস্থায় কোন অস্ত্রধারী ব্যক্তিকে অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া হলে কোন সমস্যা নেই । কিন্তু সমাজটি যদি আদর্শ সমাজ না হয়, তখনই সংকটের সৃষ্টি হয় । এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে । উদাহরণটি ইসলামের প্রথম যুগের । তখন যুদ্ধের আগে বিবাদমান দুই দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুজনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হতো । সেই মল্লযুদ্ধের ফলাফল অনেক সময় উভয়পক্ষ নিজেদের জয়পরাজয় হিসাবে মেনে নিত । এ রকম একটি যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) একটি মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন । অনেকেই জানেন শারীরিক শক্তি বিচারে হযরত আলী (রাঃ) কে শের- -এ- খোদা বলা হত । শের- এ -খোদা অর্থ ‘আল্লাহর বাঘ’ । যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (রাঃ) যখন প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করতে যাবেন; তখনই লোকটি নিচে থেকে তাঁর মুখে একগাল থুথু ছিটিয়ে দেন । সাথে সাথে হযরত আলী (রাঃ) লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান । সে আমলে এ ধরণের পরাজিত কাউকে হত্যা না করা পরাজিত লোকটির জন্য অনেক বেশী অপমানকর গন্য করা হত । লোকটি তাই শুয়ে থেকেই চিৎকার করতে থাকে, ‘তুমি আমাকে হত্যা কর, হত্যা কর । তুমি দেরী করছ কেন ? আমাকে হত্যা কর ।‘ হযরত আলী (রাঃ) ধীরে ধীরে বলেন, ‘দেখ, তোমার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই । আমি আমার ধর্ম রক্ষার কারণেই তোমার সাথে যুদ্ধ করেছি । কিন্তু যখন তুমি আমার মুখে থু থু দিয়েছো; তখন তোমার উপর আমি রেগে গেছি । এখন যদি তোমাকে আমি হত্যা করি, তাহলে তা হবে আমার ব্যক্তিগত রাগের কারণে হত্যা । ধর্মের কারণে নয় । তাই তোমাকে আমি হত্যা করব না ।‘
একজন মানুষ যদি হযরত আলী (রাঃ)’ র মত ব্যক্তিগত রাগবিরাগকে নিজের পেশার সাথে গুলিয়ে না ফেলেন, তাহলে যেকোন ব্যক্তিকে যেকোন ধরণের ক্ষমতা দিলে কোন অসুবিধা হয় না । আমাদের নীতিনির্ধারক মহল যখন শপথ বাণী পাঠ করেন; তখন তাঁরা এই কথাই বলেন যে, তাঁরা ব্যক্তিগত লোভ লালসা, রাগবিরাগের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালন করবেন । আর আমরা যারা কোন শপথবাক্য পাঠ করিনে, তারাও কিন্তু দায়িত্ব মুক্ত নই । আমরাও যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবো – এটাই আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার কথা । কিন্তু, বাস্তবে তা কি হয় ?
বাস্তবে আমাদের সমাজে কি হয় এবং কি হচ্ছে তা সকলের জানা । আমি সে আলোচনায় যাব না । আমি শুধু এ বিষয়ে ধর্মের কী বিধান রয়েছে সেই কথাটিই বলব । এ বিষয়ে প্রধান প্রধান সব ধর্মের বিধান মূলত একই । আমি ইসলাম ধর্মের কথাই বলব ।
ইসলাম ধর্মের বিধান মতে মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীকে কোন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি । প্রকৃত ক্ষমতার মালিক স্বয়ং আল্লাহ নিজে। মানুষের আপাত দৃষ্টিতে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা মূলত তাকে পরীক্ষা করার জন্য । যেমন, একজনকে টাকা দিয়ে ক্ষমতাবান করা হয়েছে । কিন্তু ধর্মের বিধান অনুযায়ী সেই টাকার মালিক সে একা নয় । এই টাকার মধ্যে তার গরীব আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের অনেকের অধিকার রয়েছে । এই টাকা দিয়ে সে নিজের ও পরিবারের জীবনযাত্রা ব্যয় নির্বাহ করার পাশাপাশি অন্যান্য কল্যাণকর কাজ করবে- এটাই ধর্মের বিধান । যাকে শারীরিক শক্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; যাকে চেয়ারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে- এ সব ক্ষমতা কারো একান্ত ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়নি । সমাজের অনাহারী মানুষ, বিপদে পড়া মানুষ যখন যে কোন একজন ক্ষমতাবান মানুষের কাছে আসে, তখন তারা করজোড়ে সাহায্য প্রার্থনা করে । বলে, ‘উপরে আল্লাহ, নীচে তুমি, তুমি আমাকে সাহায্য কর ।‘ সেই মুহূর্তে সেই ক্ষমতাবান মানুষকে সত্যিই তার কাছে আল্লাহর মতই ক্ষমতাবান মনে হয় । আর আল্লাহ প্রদত্ত সেই ক্ষমতা নিয়ে যারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে; যারা তার উপকার না করে ক্ষতি করে; তার কৈফিয়ত স্বয়ং আল্লাহর কাছেই তাকে দিতে হবে । এটাই ধর্মের অমোঘ বিধান ।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুন ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ৩০ অক্টোবর, ২০২০ ।