রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (চার)
প্রকাশ: ১২:১২ এএম, ৪ নভেম্বর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০১:২৭ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
এখন রমনা পার্কের ভরা যৌবন যেন । জনবহুল ঢাকার অগণিত মানুষের পদভারে সদা ক্লান্ত থাকে সে । নিজেকে সাজাবার সময় কোথায় তার ? কিন্তু করোনা মহামারি আশীর্বাদ হয়েছে তার জন্য । অনেকদিন বন্ধ ছিল পার্ক । নিজেকে সাজাবার অফুরন্ত সময় পেয়েছে সে। তাইতো সেজেছে সে এক অপরূপ সাজে ! রমনার বাহারি রূপে মুগ্ধ আমি প্রভাতের শুভ্র আলোয় সীমানা সংলগ্ন ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে থাকি ।
আমার মত ওয়াকওয়েতে হাঁটা মানুষ একেবারে কম নয় । অনেকে আছেন সমমনাদের নিয়ে একসাথে নিজেদের মত ব্যায়াম করেন । যারা শুধু হাঁটতে চান, তাঁরা ওয়াকওয়েতে হাঁটেন । ওয়াকওয়েটা বেশ প্রশস্থ । পাশাপাশি কয়েকজন একসাথে হাঁটা যায় । একপাক হাঁটলে ১৬২৬ মিটার হয় - প্রায় ১ মাইল ১৩ গজের মত । যাঁদের হাতে সময় থাকে, তাঁরা কয়েক পাক দিয়ে থাকেন । এছাড়াও রমনা পার্কের মধ্যে ছোটবড় অনেক ওয়াকওয়ে রয়েছে ।
আমার সামনে একটা পান্থপাদপ গাছ । এ গাছের প্রস্ফুটিত পাতা অনেকটা কলাপাতার মত । কিন্তু গাছেটির এরকম নাম কেন ? আমি ‘পান্থপাদপ’ শব্দের মানে দিয়ে গাছটি চেনার চেষ্টা করি ।
‘পান্থ’ মানে পথিক, আর ‘পাদপ’ মানে গাছ । শব্দগত দিক থেকে পান্থপাদপ মানে ‘পথিকের গাছ’ । ইংরেজী ‘traveler’s tree’ কে বাংলায় পান্থপাদপ বলা হয়েছে । আমি অবাক হই আমাদের পূর্ব পুরুষদের জ্ঞানগরিমা দেখে । আমাদের আশেপাশে যত নদনদী, গাছপালা, প্রাণী আছে সবকিছুর নামকরণ করেছেন তাঁরা । কপোতাক্ষ , কুমার, পদ্মা, মেঘনা, , বাঘ, সিংহ, হরিণ, দোয়েল, ঘুঘু, কবুতর, পলাশ, লজ্জাবতী ইত্যাদি ইত্যাদি যে নামই বলিনা কেন- সবই আমাদের পূর্বপুরুষের দেওয়া নাম । আমরা কি এসবের এর থেকে সুন্দর কোন নাম দিতে পারতাম ? বোধহয় না । অসম্ভব ! তাহলে কোন বিচারে সেকেলে মানুষদের আমরা অবজ্ঞা করি ?
‘পান্থপাদপ’ গাছটি আসলে আমাদের দেশীয় গাছ নয় । এটি সুদূর মাদাগাস্কার থেকে আনা । মাদাগাস্কার ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র । পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এটি । এখানকার মরুময় এবং খরাপ্রবণ এলাকার গাছ এই ‘পান্থপাদপ’ । বাংলাদেশের মত নাতিশীতোষ্ণ এবং নদীমাতৃক দেশে এ গাছের তেমন কোন মূল্য নেই । কিন্তু মাদাগাস্কারের মরুভূমিতে এ গাছ পথিকের জীবন রক্ষাকারী গাছ । এ গাছের কাণ্ডগুলো পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কোণাকুণি থাকে- যা কম্পাসের মত কাজ করে । মরুভূমির পথ হারানো মানুষের পথের দিশা দেয় এই পান্থপাদপ । এ গাছের কাণ্ড ভরা সুপেয় পানি । মরুভূমির তৃষ্ণার্ত পথিক এই পানি পান করে জীবনী শক্তি ফিরে পায় । কিন্তু রমনা পার্কে এ গাছ রাখা হয়েছে কেন ? আসলে এটি একটি সৌন্দর্যবর্ধক গাছও বটে । রমনা পার্কে ফুল ও এ ধরণের সৌন্দর্যবর্ধক প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা ৮৭টি ।
আসলে বন ও বাগানের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । বন সাজায় প্রকৃতি; আর বাগান সাজায় মানুষ । বনের ভারসাম্য রক্ষা করে অনেক হিংস্র প্রাণী । যেমন সুন্দরবনের বাঘ বনের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক বড় ভুমিকা পালন করে । সুন্দরবনে হিংস্র বাঘ না থাকলে অনেক আগেই বনটি উজাড় হয়ে যেত । লোকালয়ে পরিণত হত বন । কিন্তু বাগানের ভারসাম্য রাখতে হিংস্র প্রাণী রাখার সুযোগ নেই। কারণ মানুষের সাজানো বাগান কেবল মানুষের চিত্তবিনোদনে ব্যবহার হয়। চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে আতংকের কোন জায়গা নেই । তাই ইংরেজ প্রাউডলককে রমনা বাগান সাঁজাতে গিয়ে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে সাথে টেকসই এবং ভারসাম্যের কথা ভাবতে হয়েছে । রমনা পার্কের আয়তন ৬৮.৫ একর । বর্তমানে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ২১১ টি । ফুল ও শোভাবর্ধক গাছের কথা আগেই বলেছি । এখানে ফল জাতীয় উদ্ভিদ ৩৬ টি, ঔষধি প্রজাতি ৩৩ টি । এছাড়া বনায়ন উদ্ভিদ প্রজাতি, বনজ উদ্ভিদ প্রজাতি, জলজ এবং মশলা উদ্ভিদ প্রজাতিসহ অনেক বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে । তবে বাগানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করে ৮.৭৬ একর আয়তনের কৃত্রিম লেক । বাগানের লক্ষ লক্ষ কীট পতঙ্গ ও প্রাণীর জীবন ধারণের মূল উৎস এই লেকের পানি । এখানে একটা উদাহরণ কতটা প্রাসঙ্গিক হবে জানিনে; কিন্তু বলার জন্য মনটা উশখুশ করছে । এটি পবিত্র কোরআনের একটি বাণী ।
পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাসী ও সৎকর্ম শীল ব্যক্তি বেহেশত যাবে’ । কোন কোন জায়াগায় এই কথাটিই আরও জোর দিয়ে বলা হয়েছে । বলা হয়েছে, ‘আমি আল্লাহ বলছি, বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি বেহেশত যাবে’ । তারমানে শুধু ইবাদত বা শুধু সৎকর্ম কাউকে বেহেশত নিতে পারবে না । বেহেশত পেতে গেলে অবশ্যই একজন মানুষকে ইবাদত এবং সৎকর্ম- দুটোই করতে হবে । আমার মনে প্রশ্ন ছিল, তাহলে পীর দরবেশদের ক্ষেত্রে কি হবে ? পীর দরবেশগণ সাধারণত লোকালয়ের বাইরে থাকেন । তাঁদের ইবাদত করার সুযোগ থাকলেও, সৎকর্ম করার সুযোগ নেই বললেই চলে ? তাহলে তাঁদের কি হবে ? অনেক চিন্তার পর একটা জবাব আমি পেয়েছি । তা সম্পূর্ণ ঠিক কিনা মহান আল্লাহই ভালো জানেন ।
আমার মনে হয়েছে প্রত্যেক আওলিয়া দরবেশ সৎকর্ম হিসাবে তাঁর আস্তানার কাছাকাছি বড় পুকুর, দীঘি অথবা জলাশয়ের ব্যবস্থা করেছেন । যেমন হযরত খান জাহান আলী বা হযরত শাহজালাল (রহঃ) এঁর দরগার জলাশয়ের কথা এখানে বলা যায় । এই জলাশয়গুলো লক্ষ লক্ষ কীট পতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবন ধারণের উৎস হিসাবে কাজ করে । প্রাউডলক ১৯০৮ সালে রমনা পার্কের কাজ শুরু করেন । দীর্ঘ ২০ বছর পরিশ্রম করে ১৯২৮ সালে এর কাজ শেষ করেন তিনি । রমনা পার্কের মাঝে অতিমনোরম এই লেক খননের ব্যবস্থা নিয়ে তিনি নিজের অজান্তেই পীর দরবেশের মত একটি পুণ্যের কাজ করেছেন । আজ এ লেখার সুযোগে মহান এই ব্যক্তির আত্মার প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । মহান আল্লাহ তাঁর আত্মার শান্তি নিশ্চিত করুন । আমিন ।
(চলবে)
ইস্কাটন, ঢাকা । ২৬ অক্টোবর ২০২০ ।