রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (তিন)
প্রকাশ: ১১:৪৩ পিএম, ২১ অক্টোবর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:০০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
এখন রমনা পার্ক উন্মুক্ত । সবার জন্য খোলা । আমি দাঁড়িয়ে আছি ওয়াকওয়েতে । আমার ডানদিকে জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্সের প্রাচীর । বাদিকে রমনা লেক থেকে বেরিয়ে আসা নালা । নালার পানি কেমন দুষিত মনে হয় যেন । লেকের পানি পরিস্কার করা হলেও, এখানকার নালা- ডোবার পানি পরিস্কার করা হয়না বোধহয় । এরকম জায়গায় আমার দাঁড়ানোর কথা নয় । কিন্তু প্রভাতের শুভ্র আলোয় অগণিত পাখির কূজন শুনে দাঁড়িয়ে যায় আমি । তারমানে রমনা পার্কের সব গাছে একইভাবে পাখি বসে না । কোন গাছে অনেক পাখি বসে; কোনটাতে একেবারেই না ।
বন্ধু হারুনের কথা মনে পড়ে আমার । তিনি একবার সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলায় এক পরিদর্শনে যান । সেখানে থানার আশেপাশের গাছগুলোতে ঝাকেঝাকে পাখি দেখে অভিভুত হন তিনি । কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে এসে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, সেখানকার গাছে একটিও পাখি নেই । এর কারণ জানতে চাইলে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিরক্ত হন । তিনি বলেন, তাঁর অফিস আঙিনার গাছগুলোতে কেন পাখি বসে না, তা তাঁর জানার কথা নয় । তাঁর উত্তরে বন্ধুটি বিরক্ত হন । থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলে অবিলম্বে তাঁকে অফিস আঙিনা পাখিবান্ধব করার পরামর্শ দেন তিনি । লিখিত প্রতিবেদনেও বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি ।
কয়েক বছর পরে বন্ধুটি যখন আরও উচ্চপদে আসীন; তখন একই অফিসারকে কুমিল্লায় বদলি করার একটা তদবির পান তিনি । পুরনো স্মৃতি মনে হতেই, তিনি সেই অফিসারকে ডেকে পাঠান । অফিসার তাঁকে চিনতে পারেন নি । কিন্তু বন্ধুটি তাহেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস আঙিনা পাখিবান্ধব করার প্রশ্ন তুললে, তিনি তাঁকে চিনতে পারেন এবং আগের মতই বিরক্ত হন । তিনি আগের মতই জানান, গাছে পাখি না বসলে, কোনকিছু করার নেই তাঁর । এ ধরণের উত্তরে বন্ধুটি আবারও বিরক্ত হন । তিনি তাঁকে কুমিল্লায় বদলি না করে, একটি পাহাড়ি অঞ্চলে বদলী করেন । তাঁর মনে হয়েছে প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোন কর্মকর্তাকে অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে; পাখি বান্ধব হতে হবে ।
আমি বন্ধু হারুনের সাথে একমত । পরিদর্শনকালে তাঁর এ ধরণের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আমাকে মুগ্ধ করে । এর সাথে দেশপ্রেমেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে । জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে পৃথিবীর ঝুঁকিপ্রবণ দেশের শীর্ষে বাংলাদেশ । সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের কারণে এদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে সত্য; তবে উন্নয়নের পাশাপাশি নগরায়ন বেড়েছে । ব্যাপক হারে পাহাড় ও গাছপালা কাটা পড়েছে । পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার মত প্রয়োজনীয় বনভূমি আমাদের নেই । এ অবস্থায় দেশের সকলে যাদি পরিবেশ বান্ধব না হয়; যার যার বসতবাড়ি এবং অফিস আঙিনা যদি পরিবেশ বান্ধব না হয়; তাহলে ভবিষ্যতের ভয়াবহ দুর্যোগ ও দুর্গতি আমাদের অনিবার্য পরিণতি হতে পারে ।
আমি বোধহয় বিষয়বস্তুর বাইরে চলে গেছি । বাস্তবে আমি এখন রমনা পার্কের একটা প্রাচীন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে । গাছটির বয়স কত ? আমি অনুমান করার চেষ্টা করি । গাছের বয়স নির্ণয়ের একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে । কিন্তু সাধারণ কলা বিভাগের ছাত্র আমি । সেই হিসাব পদ্ধতি আমার জানা নেই । তবে ইতিহাস আমার জানা । আমি ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে গাছটির বয়স জানার চেষ্টা করি ।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন । তিনি সুবেদার ইসলাম খান চিশতীকে সুবেদার নিযুক্ত করেন । এই নিয়োগে খুশী হয়ে সুবেদার ইসলাম খান ঢাক বাজিয়ে আনন্দ উৎসব করেন । কথিত আছে, সেদিনের ঢাক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করা মানুষের মনে এমন প্রভাব ফেলে যে, এই নগরীর নাম পরবর্তীতে ঢাকা হয়ে যায় । আবার অনেকে বলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কারণে এই নগরীর নামকরণ করা হয় ঢাকা । তবে ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান ঢাকা নগরীর পত্তন ঘটান এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে তখন রাজধানীর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর । রমনা নামটি মোঘলদের দেওয়া । সুবেদার ইসলাম খান রমনা সংলগ্ন এলাকাকে একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে তোলেন । কিন্তু পরবর্তীতে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করা হলে, ঢাকা নগরীর গুরুত্ব কমে যায় এবং ধীরে ধীরে রমনা অঞ্চল ঘন জঙ্গলে পরিণত হয় । তবে আমার সামনের গাছটি সেই সময়ের নয় ।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলের কথা । ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ কালেক্টর ডাউইজ ঢাকা নগর উন্নয়নের পদক্ষেপ নেন । তিনি রমনা পার্কের দক্ষিন দিকটা ঘিরে ঘোড়দৌড়ের মাঠ তৈরি করেন । ইংরেজ বীরের জাতি । ইউরোপের ছোট একটা দেশের প্রতিকুল পরিবেশে বেড়ে ওঠা ইংরেজ টগবগে ঘোড়ার মত গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ায় । ঘোড়দৌড় বা রেসকোর্স তাই তাদের রক্তে উন্মাদনা জাগায় । মূলত পূর্ব বাংলায় কর্মরত ইংরেজেদের চিত্তবিনোদনের জন্যই রমনার দক্ষিণ দিকে গড়ে ওঠে রমনা রেসকোর্স ময়দান । পরবর্তী কালে ঢাকার নবাব পরিবার পুরনো হাইকোর্ট ভবন এলাকা থেকে রমনা গ্রিনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একটি রাজকীয় বাগান গড়ে তোলেন । সেই বাগানের নাম দেন, ‘শাহবাগ’ । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রমনা রেসকোর্স ময়দানের নামকরণ হয় ‘সোহরাওয়ার্দি উদ্যান’ । তবে আমার সামনের গাছটি সে সময়েরও নয় বলে আমার মনে হয় ।
প্রকৃতপক্ষে আধুনিক রমনা পার্ক প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনা হয় ১৯০৮ সালে । ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের আদেশে পূর্ববাংলা এবং আসামকে নিয়ে একটি ভিন্ন প্রদেশ গঠন করেন । প্রাদেশিক রাজধানী হয় ঢাকা । তখনকার অভিজাত ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্যই মূলত লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অনুরূপ একটি গার্ডেন প্রতিষ্ঠার জন্য মিঃ প্রাউডলককে ঢাকায় আনা হয় । প্রাউডলক ছিলেন কিউই গার্ডেনের অন্যতম একজন কর্মী । আমার মনে হয় সামনের গাছটি প্রাউডলকের প্রথম দিকে লাগানো একটি গাছ । আমার ধারণা ঠিক হলে গাছটির বর্তমান বয়স ১ শত ১২ বছর । অবশ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছটির প্রকৃত বয়স বের করা সম্ভব ।
আমি লেকের গাঁ ঘেঁষে ওয়াকওয়ে বরাবর হাঁটতে থাকি । সবুজ গাছপালা ঘেরা লেকের পানি সবুজাভ মনে হয় । ৮.৭৬ একর আয়তনের এই লেক রমনা পার্কের অনুপম সৌন্দর্যের একটি বড় কারণ । আমি লেকের ছবি তোলার চেষ্টা করি ।
রমনা পার্কে ঢোকার বেশ কয়েকটি গেট আছে । তবে মিনটো রোড সংলগ্ন গেটটি দেখলেও বোঝা যায় সেটি একমাত্র ভিআইপি গেট । গেটের নাম ‘অরুণোদয়’ । মিনটো রোড সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত অভিজাত শ্রেণির বাসিন্দাদের জন্যই গেটটি করা । গেটের ডানদিকে আর একটু হাঁটলে আরও একটি গেট । সেটি মূলত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের অভিজাত মেহমানদের জন্য । যে কোন পাঁচতারকা হোটেলে ব্যায়ামাগার থাকে । কিন্তু আমার মত অনেকে আছেন, যারা চার দেয়ালের মধ্যে ব্যায়াম করতে চান না । তাঁদের কথা ভেবেই মূলত গেটটি তৈরি হয়েছে ।
ভিআইপি গেট দিয়ে ঢুকলেই বাদিকে মহিলা অঙ্গন । এর চারদিকটা ঘেরা । অভিজাত এলাকার বায়ু সেবনকারী মহিলাগণ এখানে নিজেদের মত ব্যায়াম করে থাকেন
(চলবে )
ইস্কাটন, ঢাকা । ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ।