রাশেদুল ইসলাম
জন্মটাই আসল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একজন ফেসবুক বন্ধু নদী ভাঙ্গন এলাকার একটি ছবি আপলোড করেছেন । একটি মাটির চুলায় ভাত ফুটছে । চুলার পাশে একটি কিশোরী মেয়ের কোলে একটি শিশু । ভাত রান্না হলেই হয়ত তাদের খাওয়া হবে ।
ভয়ংকর নদী ভাঙ্গন আমার জীবনে একবারই মাত্র সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয় । শুধু যে কাঁচারাস্তা বা মাটির ঘরবাড়ি নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়, তা নয়; পাকারাস্তা, বড় বড় দালানকোটা সবকিছু নিমিষেই নদী গর্ভে হারিয়ে যায় । সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। তাই যমুনা তীরবর্তী বা নদী ভাঙ্গন এলাকার মানুষের জীবন চরম এক অনিশ্চয়তায় কাটে সারাজীবন । কারণ,তাদের জন্ম সেখানে । সুনামগঞ্জ হাওর এলাকার বানভাসী মানুষ, সিলেট অঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষ এই মুহূর্তে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে । শুধু এবার নয়, প্রায় প্রতিবছরই এমন দুরবস্থার শিকার হতে হয় তাদের। কারণ তারা ঐ অঞ্চলের মানুষ । ওদের সকলের বাড়ি যদি মালেশিয়ার মত দেশে হত, তাহলে তাদের জীবন এমন অনিশ্চিত হত না । কারণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বন্যা ঝড়বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মালেয়েশিয়ায় কখনো হয় না । তাই মালেশিয়ার জনগণ অন্তত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সব সময় নিরাপদ থাকে । কারণ, তাদের জন্ম সেখানে । যে মেয়েটি মা বাবার বাধ্য, সংসারের সবকাজ গুছিয়ে করে, সেই মেয়েটিই বিয়ের দু’বছর পার হতেই বিধবা হয়, সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভাসে সে । আর যে মেয়েটি বাবার সংসারে কুটোটি নাড়েনি কখনো, উড়নচণ্ডী স্বভাবের কারণে মা বাবার ঘুম হারাম করেছে, সেই মেয়েটিই পরবর্তীতে তার একই স্বভাব বজায় রেখেছে । শ্বশুর বাড়িতেও কোনদিন কোন কুটো নাড়তে হয়নি তাকে । আজীবন সুখে কেটেছে তার জীবন । শুধু জন্মলগ্ন পার্থক্যের কারণেই দেখি একজন সংসারে আজীবন সুখে থাকে, অন্যজন সীমাহীন অনিশ্চিত দুঃখের জীবন কাটায়। এসব বিচারে আমার মনে হয়, মানুষের কর্ম নয়; জন্মটাই আসল ।
আমি এক সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি । সেখানে আমার এক সহকর্মী এক সময় একটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন । তিনি কখনো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন, একথা কেউ ভাবেনি । অনেক বছর অনেক চিকিৎসার পর তাঁর চলাচল স্বাভাবিক হয় । গতকাল তার স্ত্রীর সাথে সচিবালয়ে দেখা । তিনিও একই ক্যাডারের কর্মকর্তা । জানান, তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্বামী সুস্থ, এখন স্ত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত । কথাটা শুনে সাথে সাথে মনটা বিষাদে ভরে যায় আমার । একই দিনে তার স্বামীর সাথে দেখা হলে আমি তাঁকে আমার মন খারাপের কথা জানাই। তিনি বলেন,
“ স্যার, কারো কারো জীবন এমনই । মেনে না নিলে শুধু কষ্টই বাড়ে”।
আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য । এর আগে তাঁর শরীরে ছোটবড় ৬/৭ টি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে । আজ নতুন দুটি অস্ত্রোপচার একসাথে করা হোল । তাঁর মনে ভয় ছিল, এবার অজ্ঞান করা হলে, সেই জ্ঞান আর ফিরে আসবে না । তাই তাঁর অবর্তমানে কার কি করণীয় সব বলে যান তিনি । অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তোর বাবাকে দেখিস' । মেয়েটি অনেক্ষন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে । আসলে এই পৃথিবী বড় মায়ার জায়গা। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে । সুখের কথা এবার অসম্ভব মানবিক এবং সুদক্ষ একজন ডাক্তারের হাতে তাঁর অস্ত্রোপচার হোল । এখনও ডাক্তারের নিবিড় পরিচর্যায় আছেন তিনি । তবে ভয়ের কিছু নেই । কিন্তু এখানেই শেষ নয় । কয়েকমাস পরে আবারও একটি অস্ত্রোপচার করাতে হবে তাঁর শরীরে ।
আমাদের দেশের মানুষ অসম্ভব ধর্মভীরু । যারা ধারাবাহিকভাবে শারীরিক কষ্ট বা কোন না কোন দুঃখের মধ্যে থাকে, তারা যে দুঃখ পেয়ে একেবারে মুখ বুজে থাকে, তা নয় । সবিস্তারে তাদের দুঃখ ও অভিযোগের কথা তারা তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে পেশ করে । খ্রিষ্টান হলে ঈশ্বরপুত্র যীশু, হিন্দু হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা অন্য কোন আরাধ্য দেবদেবী, আর মুসলমান হলে আল্লাহ্কে জানায় তারা । এ সব চিরদুখী মানুষের করুণ ফরিয়াদ নিয়ে হৃদয়স্পর্শী অনেক গানও রয়েছে । যেমন নীচের একটি -
“দয়াল কি সুখ তুমি পাও,
সুখের ঘরে আগুন দাও,
যে জন তোমার দয়ার কাঙ্গাল,
তারে কাঁদাও ।
দয়াল-
যে জন তোমার দয়ার কাঙ্গাল,
তারে কাঁদাও” ...
চিরদুখী মানুষের এসব দুঃখ বেদনার ফরিয়াদে সৃষ্টিকর্তার পক্ষেও জবাব আছে । ঈশ্বর পুত্র যীশুর জবাব বাইবেলে, ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জবাব ভগবত গীতায় এবং মহান আল্লাহর জবাব পবিত্র কোরআন থেকে জানা যায় । এসব জবাবে ভুক্তভোগী মানুষ কতটা খুশী হয়, সেটা বড় কথা নয়। কারণ, আমার সহকর্মীর ভাষায়, এ অবস্থা মেনে নিতে হয় । তা না হলে শুধু মনের কষ্টই বাড়ে ।
সকল ধর্মে মহান সৃষ্টিকর্তার জবাবের ভাষা বা ধরণ ভিন্নরূপ হলেও সারকথা একই । এখানে পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে । পবিত্র কোরআনের মর্ম অনুযায়ী মানুষের বর্তমান অবস্থা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা দ্বারা নির্ধারিত হলেও কর্ম তার ভাগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করে । কিন্তু তার বর্তমান অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, তাকে আলহামদুলিল্লাহ্ বলতে হবে বা তার বর্তমান অবস্থার জন্য তাকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে । তারমানে এই যে, বানভাসী একজন মানুষ যিনি এই মুহূর্তে পরিবারের সকলকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁকে যেমন আলহামদুল্লিয়াহ বলতে হবে, আমার স্ত্রী, যার শরীরে একটার পর একটা অপারেশন করাতে হচ্ছে,তাঁকেও একইভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে ।
পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী একজন মানুষ অন্যের দুঃখের বিষয়টি জানে না বা অনুভব করার চেষ্টা করে না বলেই সে নিজেকে বেশী বঞ্চিত ও দুঃখী মনে করে । কিন্তু আমার স্ত্রীর মত দুঃখী মানুষেরা যদি নিজেদের অন্য মানুষের সাথে তুলনা করেন, তাঁরা যদি ভাবেন, শুধু বানভাসী বা বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ নয়, এদেশের অনেক এলাকার মানুষের শরীরে তাঁর রোগের মত অনেক কঠিন রোগ আছে, অনেক কষ্ট আছে, কিন্তু তাঁদের চিকিৎসা করানোর মত আর্থিক সামর্থ্য নেই । এমনকি কোন কোন এলাকায় চিকিৎসা করার মত ডাক্তারও নেই । তাহলে সহজেই তাঁরা তাঁদের জীবনের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারেন । একইভাবে বানভাসী মানুষের মধ্যে যারা থাকার আশ্রয় পেয়েছেন, তাঁরা যদি আশ্রয়হীনদেন কথা ভাবেন, তাহলে তাঁরা দেখবেন মহান আল্লাহ্ তাঁদের অনেকের থেকে ভালো রেখেছেন । এই কারণে তাঁদেরকেও একইভাবে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করতে হবে । তবে যে কোন মানুষের জন্য শুধু আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাই যথেষ্ট নয়, একজন মানুষ যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তাঁর নিজের প্রতিবেশির প্রতি দায়িত্বসহ সব ধরণের ধর্মীয় দায়িত্ব তাঁকে পালন করতে হবে । তাই ধর্মীয় বিচারে মানুষের জন্ম নয়, কর্মটাই আসল ।
এ পৃথিবীতে আমরা সকলেই এক একটা পরীক্ষার মধ্যে আছি । কারো প্রশ্নপত্র কঠিন, কারোটা একেবারে সহজ । কিন্তু সব প্রশ্নের মান কি সমান ?
মহান আল্লাহ্ আমাদের সুস্থ রাখুন ।
২৩ মে, ২০২২,মনোয়ারা হাসপাতাল, সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা ।