রাশেদুল ইসলাম
বাংলাভাষা এবং আমার দুটি বই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:১৪ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
অমর একুশে বইমেলা -২০২২ উপলক্ষ্যে অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশনের পক্ষে ‘আমার কৈশোর স্মৃতি ও বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘ধর্মের প্র্যাকটিক্যাল’ নামে দুটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে । ওমিক্রনের কারণে আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা উৎসব না হলেও, চলমান বইমেলায় বই দুটি পাওয়া যাচ্ছে । ইছামতি প্রকাশনী এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞাপনও দিয়েছে । তবে, বিজ্ঞাপনে বই দুটির বিষয়বস্তুর উপর গুরুত্ব না দিয়ে, লেখক পরিচিতির উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । বলা হয়ে থাকে ‘প্রচারেই প্রসার’। কথিত আছে, জগত বিখ্যাত আইরিশ লেখক জর্জ বারনার্ড শ’ নিজেও ক্রেতা সেজে তাঁর নিজের বইয়ের প্রচার নিজে করেছেন । ফলে আমার মত অখ্যাত লেখকের বই প্রচার ছাড়া চলবে না- এটাই বাস্তব । কিন্তু, আমার আপত্তি লেখক পরিচিতিকে গুরুত্ব দেওয়া নিয়ে । এটাও ঠিক, কোন সেলিব্রিটি বা বিখ্যাত কোন ব্যক্তি কিছু লেখা শুরু করেছেন জেনেই, অনেক পাঠক বইটি কিনবেন বলে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন । ফলে, তাঁদের ক্ষেত্রে লেখক পরিচিতির গুরুত্ব থাকলেও, আমার মত অখ্যাত লেখকের বেলায় তা একেবারেই প্রযোজ্য নয় ।
‘আমার কৈশোর স্মৃতি ও বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপুরুষ নিয়ে লিখতে গিয়ে ইতিহাসের একটি ব্যতিক্রম বিষয় আমার নজরে আসে । এখানে বিষয়টি শেয়ার করা যেতে পারে –
প্রাচীনকালে ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়িক কারণ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে ভিনদেশীয় অনেক মানুষ তৎকালীন বাংলায় এসেছেন । এদেশের জলবায়ু, মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে তাঁদের অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । যেমন, ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পরিবার । তাঁর পূর্বপুরুষ খাজা আব্দুল ওহাব এবং খাজা আবদুল্লাহ কাশ্মীর থেকে ব্যবসায়িক কারণে এদেশে আসেন । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষ শেখ আওয়াল হযরত বায়েজিদ বোস্তামির সফরসঙ্গী হয়ে ইরাক থেকে ধর্ম প্রচারে বাংলায় আসেন । এই দুই পূর্বপুরুষের সকলেই এদেশে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন । এভাবে ভিনদেশ থেকে আসা মুসলমানগণের একটি বড় অংশ নিজেদের ‘আশরাফ’ বা উচ্চ বংশীয় মনে করতেন । জন্মগতভাবে এদেশের মুসলমানদের তাঁরা ‘আতরাফ’ বা নিচু বংশের মনে করতেন । এই ‘আশরাফ’ এবং ‘আতরাফ’ বা উঁচু এবং নিচু জাতের মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রক্ষার মাধ্যম ছিল ভাষা । পারিবারিক ভাষা । যেমন, ঢাকার নবাব পরিবারের ভাষা ছিল ফারসী এবং উর্দু । এদেশের প্রচলিত ভাষা বাংলাকে তাঁরা নিচু জাতের ভাষা মনে করতেন । তারমানে ভিনদেশ থেকে আসা এবং এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করা তৎকালীন বাংলার মুসলমান দুভাগে বিভক্ত ছিল-
১) ভিনদেশ থেকে আসা এবং এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করা মুসলমান, যারা নিজেদের ‘আশরাফ’ বা উচ্চ বংশীয় মনে করতেন । এদেশের জন্মগত মুসলমানদের তাঁরা ‘আতরাফ’ বা নিচু বংশের মনে করতেন । এই পার্থক্য বজায় রাখার জন্য তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভাষায় কথা বলতেন । এদেশীয় মানুষের ভাষা বাংলা ভাষায় তাঁরা কথা বলতেন না । যেমন, ঢাকার নবাব পরিবার ।
২) ভিনদেশ থেকে আসা এবং এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করা মুসলমান, যারা এদেশের মাটি মানুষের সাথে মিশে যান । তাঁরা কখনো এদেশের মানুষের সাথে নিজেদের কোন পার্থক্য করেন নি । তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভাষা বাদ দিয়ে এদেশীয় মানুষের ভাষা বাংলায় কথা বলতেন । যেমন, টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবার । তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের মাতৃভাষা আরবী বাদ দিয়ে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে যান ।
অল ইনডিয়া মুসলিম লিগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ জন্মগতভাবে গুজরাটি ছিলেন । তাঁর মাতৃভাষাও ছিল গুজরাটি । কিন্তু, তিনি শুধু নিজের মাতৃভাষা গুজরাটি ভাষাকে ছোটজাতের ভাষা মনে করতেন তা নয়, তিনি তৎকালের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সিকেও নিম্নমানের ভাষা মনে করতেন। ইংরেজী সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর পরিবার ইংরেজী ভাষাকেই আদর্শ মনে করেছেন এবং সেই ভাষাতেই তাঁরা কথা বলেছেন । কখনো উর্দু বা ফার্সিতে কথা বলেননি । ফলে, যুক্তির দিক দিয়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বা উর্দু হওয়া নিয়ে কোন মাথাব্যাথা থাকার কথা নয় । কারণ, এ দুটি ভাষার কোনটিই তাঁর প্রিয় ভাষা ছিল না ।
সকলেরই জানা ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করেন । এই ‘মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার জোতদার শ্রেণির লোকেরা (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৩৫)। তারমানে মুসলিম লীগের সকলেই ছিলেন এ দেশের ‘আশরাফ’ বা উচ্চ বংশীয় গোত্রের মুসলমান, যাদের কথা আগে বলা হয়েছে । আর ‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৩৫) ।
এটাও সকলের জানা যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন । সেই ভাষণে তিনি, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন । এর পরের ইতিহাস সকলের জানা । আর এটাও জানা যে, এই ঘোষণা তৎকালে যিনি ‘কায়েদে আযম’ বিশেষণে খ্যাত ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে । তাহলে প্রশ্ন আসে, মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মত তুখোড় একজন রাজনৈতিক নেতা কেন সেদিন এই আত্মঘাতী ঘোষণা দিলেন ?
ইতিহাস পর্যালোচনায় আমার মনে হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঢাকা নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন ও মুসলিম লীগের তাঁর সমমনা নেতৃবৃন্দ গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে বোঝান যে, বাংলা এ দেশের ‘আশরাফ’ বা উচ্চ বংশীয় গোত্রের মুসলমানদের ভাষা নয় । বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের নিচু জাতের মানুষের ভাষা । ফলে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে, এ দেশের ‘আশরাফ’ বা উচ্চ বংশীয় মুসলমানদের সম্মানের হানি হবে । মুহম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে যেহেতু নিজের গুজরাটি মাতৃভাষাকে ছোটজাতের ভাষা মনে করতেন, খাজা নাজিমুদ্দিনের এই পরামর্শ তিনি গুরুত্বের সাথে নেন । বিষয়টি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ বলে আমার মনে হয়েছে । তবে, ইতিহাসে এ ধরণের কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই ।
বই দুটিতে ধর্ম বিষয়ে আমার লেখাও বোধহয় ব্যতিক্রম । স্বয়ং পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘আমি ইউরোপে ইসলাম দেখেছি, কিন্তু মুসলমান পাইনি; ভারত উপমহাদেশে মুসলমান দেখেছি; কিন্তু ইসলাম পাইনি’ । প্রকৃত সত্য এই যে, আমরা মুসলমান যেভাবে ধর্মচর্চা করি, আমাদের বাস্তব কাজে তার কোন প্রতিফলন ঘটেনা । ফলে, আমাদের ধর্মচর্চার বাস্তব কোন সুফল সাধারণ মানুষ পায়না । অথচ, সামাজিক শান্তি রক্ষার জন্যই ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে । আমার বই দুটিতে এ উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনার পাশাপাশি আমাদের দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত, সমস্যা ও তা সম্ভাব্য নিরসনের উপায় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে । এদেশে সকল ধর্মবর্ণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে । নীতিগত সমর্থন পেলে ভিন্নরূপ যে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কেউ তাঁর মূল্যবান পরামর্শ দিতে পারেন ।
১৯৫২ সালের এই দিনে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য রফিক, শফিক, বরকতসহ যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য অবদান রেখেছেন, তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি । মহান আল্লাহ্ তাঁদের উত্তম পুরষ্কার দিবেন - এই প্রার্থনা আমাদের ।
মহান একুশের শুভেচ্ছা সকলের জন্য ।
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ । ইস্কাটন, ঢাকা ।