রাশেদুল ইসলাম
একাকীত্বের মাশুল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:১৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
জনাব আবু মহসিন খান । বয়স ৫৮ । সামাজিক বিচারে সফল একজন ব্যক্তিত্ব । ধানমণ্ডির একটা ফ্ল্যাটে একা থাকতেন । গতরাতে নিজের কপালে নিজের পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন তিনি । গোপনে নয় – একেবারে ফেসবুক লাইভে এসে এটা তিনি করেছেন । সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে করেছেন । মৃত্যুর আগে তাঁর দেওয়া বক্তব্য আমি শুনেছি ।
জনাব আবু মহসিন খান আমার পরিচিত নন । কিন্তু এক নজর দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের বিচক্ষণ একজন ব্যক্তি ছিলেন । এ ধরণের মানুষ সাধারণত অন্তর্মুখী (Introvert) হয়ে থাকেন । নিজের মানসিক যন্ত্রণার কথা অন্যকে বুঝতে দেন না । ফেসবুক লাইভে তিনি বলেছেন, একাকীত্ব তাঁর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে । জীবনে নিজের বাবাসহ সকলেই তাঁর সাথে প্রতারণা করেছেন । সমাজে মানুষের লোভ ও ছলচাতুরীর সাথে তিনি খাপ খাওয়াতে পারছেন না । নিজের আপনজন যে সত্যিকার অর্থে আপনজন নয়- এসব চরম সত্য অনুধাবনের পর তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
জনাব আবু মহসিন খানের এই মৃত্যু অনেক বড় প্রশ্নবোধক । সমাজ জীবনে আমরা কোন দায় নিতে চাইনে । কোন বিষয়ে নিজেদের দায় স্বীকার করা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই । ফলে তাঁর মৃত্যুর দায় এখন কোন আপন জন বা পর জন - কেউ নিবেন না । কারণ, উনি আত্মহত্যা করেছেন তাতে আমাদের কি ? এখানে আমাদের দোষ কোথায় ? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন ।
তবে, এটাও আমাদের সমস্যা যে, আমরা নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য, যে কোন বিষয়ের তাৎক্ষণিক জবাব দিই । কোন কিছু ভেবে বলিনে । আর কোন কিছু ভাবার সময়ও আমাদের নেই। কিন্তু খোঁচা মারা কথা বলতে আমরা ওস্তাদ ।
জনাব আবু মহসিন খান আত্মহত্যা না করে যদি বলতেন, একাকীত্ব তাঁর জন্য অসহ্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে তিনি একটি বৃদ্ধ আশ্রমে উঠতে চান । সেখানে সমবয়সী, সমমনা অনেকে আছেন । তাঁদের সাথে ভাববিনিময় করে তাঁর সময় কাটবে । এর ফলে কি হতো ?
নিকট আত্মীয় সবাই হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠতেন । আমরাও তাঁদের সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধ আশ্রম যে অমানবিক এবং সামাজিক মর্যাদা হানিকর জায়গা, সেটাই বলতাম। তাঁকে সমর্থন দিতাম না । আর তাঁর নিজের জন্য বিয়ে করার কথা বললে তো কথা নেই ।
জনাব খান বলেছেন যতদিন আপনজনদের চাহিদা মেটাতে পেরেছেন, ততদিন কোন অসুবিধা হয়নি । যখনই বয়সের কারণে তিনি তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না, তখনই সমস্যা । তিনি বিশ্বাস করে যাদের টাকা দিয়েছেন, তা ফেরত পাচ্ছেন না । ৫ কোটি টাকার বেশী তাঁর অনাদায়ী রয়ে গেছে । নিজের বাবাসহ সকলেই তাঁর সাথে প্রতারণা করেছেন ।
বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা এখন সমাজে অতিসাধারণ ঘটনা । শুধু বাইরের মানুষ নয়; নিজের আপনজনেরাও এটা করছেন বা করে থাকেন; যার জীবন দিয়ে মাশুল দিলেন বা দিয়ে থাকেন জনাব আবু মহসিন খানের মত বিশুদ্ধ ভদ্রলোকেরা । তবে যে মানসিক সমস্যায় জনাব মহসিন আত্মহত্যা করেছেন, সেই একই সমস্যা যেকোন মানুষের হতে পারে- এই কথাটি বলার জন্য আমার এই লেখা ।
প্রকৃত পক্ষে মানুষের মন কারো আপনও নয়, পরও নয় । মন নিজে ভালো বা মন্দ বোঝে না । মনকে যা বোঝানো হয়, মন তাই বোঝে । পবিত্র কোরআনে যা বলা হয়েছে, তার সারকথাও একই। একজন মানুষ যা চিন্তা করে,মহান আল্লাহ্ তার চিন্তা সেদিকেই নিয়ে যান । এ কারণে যে ব্যক্তি মানুষের ক্ষতি করে, সে মানুষের ক্ষতি করার চিন্তা করতে করতে এমন পর্যায়ে যায়, যে শয়তানও তার কাজে লজ্জা পায় । আবার যে ব্যক্তি মানুষের ভালো করার কথা চিন্তা করে, তার ভালো কাজের চিন্তা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ফেরেস্তাকেও হার মানায় ।
জনাব আবু মহসিন খান একাকি থাকতে থাকতে চিন্তা করেছেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন । শেষ পর্যন্ত তিনি চিন্তা করে পেয়েছেন যে, তাঁর বাবাসহ সকলেই তাঁর সাথে প্রতারণা করেছেন । এই নেগেটিভ চিন্তার চূড়ান্ত ফলাফল তাঁর করুণ মৃত্যু । কিন্তু তিনি যদি বিপরীত চিন্তা করতেন যে, তিনি জীবনে কী না পেয়েছেন ! তিনি সন্তানদের ঠিকমত মানুষ করেছেন । শেষ বয়সে নিজে স্বাধীনভাবে থাকার সুযোগ পেয়েছেন । এই ১৭ কোটি মানুষের দেশে তাঁর মত সৌভাগ্যবান কয়জন আছে ? প্রতারক কিছু বন্ধুবান্ধব তাঁর আছে সত্য; তাঁর জন্য কি জীবন দিতে হবে ? জীবনে কত কিছুই তো করার আছে !
আমরা সবাই আর একটি ভুল করি । আমরা মনে করি, জীবন মানে নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য কাজ করা । নিজের এবং নিজের পরিবারকে সুখী করার একমাত্র চেষ্টা এক ধরণের মায়ামরীচিকার পিছনে ছোটার মত । এ ধরণের ছুটতে গিয়ে আমরা যখন হিসাব মিলাতে যাই, তখনই হোঁচট খেতে হয় । দেখা যায়, আপনজনদের কাউকে শেষ পর্যন্ত খুশি করা যায়নি । তখন অনেকেই মহসিন খানের মত নিজের জীবনকে অর্থহীন ভাবেন । তাঁর মত সাহস করে কেউ আত্মহত্যা করেন না সত্য; কিন্তু মনে মনে মৃত মানুষ হয়ে যান ।
কিন্তু আমরা যদি নৈতিকতা বা নিজ নিজ ধর্মের ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে নিজের ও পরিবারের জন্য কাজ করার পাশাপাশি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করি, তাহলে কোন পরিস্থিতিতে জীবনকে অর্থহীন মনে হওয়ার কথা নয় । এভাবে অর্থহীন জীবন বিসর্জন দেওয়ারও প্রয়োজন হয় না ।
আমার মনে হয়েছে জনাব আবু মহসিন খান একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ ছিলেন । একজন মানুষের দোষগুণ দুটোই থাকে । মহান আল্লাহ্ তাঁর ভালো গুণ বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে ক্ষমা করবেন- এই প্রার্থনা করি ।
মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে হেদায়েত করুন ।
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ । ইস্কাটন, ঢাকা ।