রাশেদুল ইসলাম
ধর্মের প্রাকটিকাল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৩৮ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
খবরটা পুরানো । আমি সেদিনের সেই পুরানো কাগজটা আবার পড়ি ।
সম্প্রতি মহামান্য আদালত ঢাকার আমিনবাজারে ৬ জন কলেজ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের সেই মামলার রায় দিয়েছেন । বিচারে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে । খবরটা পড়ার পর থেকে সেই ৬ জন ছাত্রের আর্তচিৎকার আমার কানে ভেসে আসছে যেন । ঘুমের মধ্যেও সেই ভয়ার্ত ছেলেদের মুখ আমি দেখি । বাধ্য হয়েই দু’ এক কথা লেখা ।
ঘটনাটা ২০১১ সালের । সেবার শবেবরাতের রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর -মিরপুর এলাকায় থাকা ৭ জন কলেজ ছাত্র আমিন বাজারের বড়দেশী গ্রামসংলগ্ন কেবলার চরে বেড়াতে যায় । সে সময় গ্রামের মানুষেরা তাদের ডাকাত সন্দেহ করে । তারা অনেক কাকুতি মিনতি করে জানায় যে, তারা ছাত্র; শবেবরাতের রাতে তারা বেড়াতে বেরিয়েছে । কিন্তু তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি । শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে করুণ ও নির্মম মৃত্যু হয় তাদের । তাদের একজন বন্ধু আল আমীন দৈবক্রমে বেঁচে না গেলে, মৃত ৬ জন ছাত্রের বাবামাকে ডাকাতের বাবামা হিসেবেই আজীবন সামাজিক ঘৃণা পেতে হত । এই রায় ঘোষণার মাধ্যমে বিচারক সেই বাবামাদের ডাকাতের বাবামা হওয়ার ঘৃণ্য অপবাদ থেকে মুক্তি দিলেন ।
যেকোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সেই ধর্মের মানুষের কাছে খুবই স্পর্শকাতর । এ ধরণের উৎসবের দিনে যারা আপনজন থেকে দূরে থাকে, তারা এক ধরণের নস্টালজিয়ায় ভোগে । আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম । আমরাও শবেবরাতের রাতে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি । অনেকে এই রাতে একাধিক মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ নিয়ে থাকে । অনেক মসজিদে শবেবরাতের নামাজের মোনাজাত ফজরের নামাজের সময় হয় । যে যেখানেই নামাজ পড়ুক, সবাই নামাজের সেই মোনাজাতে শরিক হতে চায় । আমিনবাজার হত্যাকাণ্ডে মোট সন্দেহভাজন আসামীর সংখ্যা ৯২ জন ছিল বলে জানা যায় । খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ৯২ জন আসামীর একটি বড় অংশ সেই হত্যাকাণ্ডের আগে বা পরে শবেবরাতের নামাজ পড়েছে । কিন্তু এই সব নামাজীর কারো মনে সেই ছাত্রদের আর্ত চিৎকার কোন ধরণের সহানুভুতির সৃষ্টি করেনি । নামাজ বা শবেবরাতের পবিত্র রাত তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি । আমিন বাজার থেকে মোহাম্মদপুর বা মিরপুরের দূরত্ব খুব বেশী নয় । তাদের বেঁধে রেখেও খোঁজ খবর নেওয়া যেত বা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা যেত । সে ধরণের মানবিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন কোন চিন্তা তাদের কারো মধ্যে কাজ করেনি সে রাতে ।
অতি সম্প্রতি ব্রাজিলের একটি মহিষের খামারে ৫০০ টি মহিষ না খেয়ে মারা গেছে বলে খবরে প্রকাশ । খামারের মালিক ব্যবসা পরিবর্তনের কারণে সেই খামারে মহিষের খাবারের কোন ব্যবস্থা করেনি । ৫০০ টি মহিষ মারা যাওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয় । সাথে সাথে বেসরকারি সংস্থার অনেক এনজিও কর্মী এগিয়ে আসেন । ছবিতে দেখা গেছে তাঁরা ফিডার দিয়ে মৃতপ্রায় মহিষদের দুধ খাওয়াচ্ছেন । অনেককে মহিষদের গা পরিস্কার করতে দেখা গেছে । এভাবে তাঁরা ৬০০ টি মহিষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন । খোঁজ নিলে দেখা যাবে এসব এনজিও কর্মীদের দলে একজনও মুসলমান নেই । থাকলেও তাঁদের সেই সেবা চাকরি বা ব্যক্তিগত নীতিবোধ থেকে করা হয়েছে; নিজের ধর্মীয় চেতনা বোধ থেকে নয় । কারণ, শুধু আমাদের দেশ নয়, আমার জানামতে, কোন মুসলিম প্রধান দেশে মানুষের মত অন্যান্য প্রাণীদের জন্য দান করা বা সেবা করা যে ধর্মের একটা বিধান, একথা কোথাও বলা হয় না ।
আমাদের দেশের কেশবপুরের হনুমান গ্রামে বিরল প্রজাতির কালোমুখী হনুমানের বাস । ২০/৩০ বছর আগে সেখানে ৫ হাজারের অধিক হনুমান বাস করত বলে জানা যায় । বর্তমানে সেই কালোমুখী হনুমানের সংখ্যা মাত্র ৪ শত । বলা যায় উপযোগী পরিবেশ এবং খাদ্যের অভাবেই এই বিরল প্রজাতির প্রাণী দিনে দিনে নিঃশেষ হতে চলেছে । এই বিরল প্রজাতির হনুমান রক্ষা করাও যে একটা ধর্মীয় দায়িত্ব, এটা জানা থাকলে অনেকেই তাদের উপযুক্ত পরিবেশ এবং খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক হতে পারেন । প্রকৃতপক্ষে শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়া করা, সেবা করার বিধান ইসলাম ধর্মে থাকলেও আমাদের সেই বাস্তব শিক্ষা দেওয়া হয় না । বোখারি শরিফের একটি হাদিসে তৃষ্ণার্থ একটি কুকুরকে পানি খাইয়ে জীবন বাঁচানোর কারণে একটি বীরাঙ্গনা মহিলার বেহেশত যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে ।
আমার এসব আলোচনার একটাই কারণ এই যে, আমি এ বিষয়ে মসজিদের ইমামসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই । আমাদের ধর্মচর্চার বিষয়টি একেবারে তাত্ত্বিক না হয়ে, ধর্মের বাস্তব প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হলে, এ সব সমস্যার ধীরে ধীরে নিরসন হতে পারে । আর এ বিষয়ে মসজিদের ইমামগণই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।
১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।