রাশেদুল ইসলাম
হাজী আব্দুল জলিল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং সুফিয়া খাতুন শিক্ষাবৃত্তি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১২:১৫ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
মোছাঃ সুফিয়া খাতুন আমার খালা । ১৯৫২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর জন্ম । পরীর মত ফুটফুটে সুন্দর এই মেয়েটি শৈশবেই পিতৃহারা হন । মা চিয়ারবানু স্বামীর ভিটেবাড়ি ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে ওঠেন । ভাই রাজনৈতিক নেতা । দেশ তখন অশান্ত । সদ্য স্বাধীন দেশ পাকিস্তান । কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে একটি নতুন দেশের জন্ম কেন্দ্রীয় সরকারের এক সিদ্ধান্তে তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে । পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা বাংলা নয়; পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায় । মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক বাঙালি নেতারা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছেন । মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে । সামনে নির্বাচন । যে মুসলিম লীগের পক্ষে জনমত গঠন করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে । যুক্তফ্রন্টকে জিততে হবে । কেন্দ্রীয় জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছুটে চলেছেন এক জেলা থেকে আর এক জেলায়; থানা থেকে গ্রাম পর্যন্ত । যশোরেও আসবেন তিনি । কি হতে যাচ্ছে দেশে ? রাজনৈতিক নেতার বাসায় গিজ গিজ করে মানুষ । আপ্যায়নের সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব বিধবা বোন চিয়ারবানুর । এত বড় বাড়িতে বাপহারা ছোট একরত্তি মেয়ের খোঁজ রাখার সময় তাঁর আছে কি ?
সুফিয়া খাতুন বুঝতে পারেন সত্যিই তিনি এতিম । তাঁর মা সারাদিন মেহমান সামলাতে ব্যস্ত । রাতে যখন শুতে আসেন, ঘুমিয়ে গেছেন তিনি । প্রতিদিন ফজর নামাজের আগেই মাকে বিছানা ছাড়তে হয় । তিনি যখন ওঠেন, তাঁর মা বিছানায় নেই । মামাত ভাইবোনের সাথে বড় হন তিনি । কোন কিছুর অভাব নেই । কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা তাঁকে মনে করিয়ে দেয়, তিনি সত্যিই একজন এতিম সন্তান । মেধাবী ছাত্রী তিনি । অনেক স্বপ্ন তাঁর । একদিন নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে মাকে নিয়ে আলাদা থাকবেন । তখন তাঁর মা শুধু তাঁর কথাই ভাববেন – স্বপ্ন দেখেন তিনি ।
উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সুফিয়া খাতুন । কিন্তু এটা শুধুই স্বপ্ন । ১৯৬৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি । সে বছরই তাঁর বিয়ের কথা চূড়ান্ত হয় । পাত্র তারই স্কুলের বিএসসি শিক্ষক আব্দুল জলিল । কাল কুচকুচে চেহারা তাঁর । কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুফিয়া খাতুন । নিজের পরীর মত চেহারার পাশে একটা ছোটখাটো কালো মানুষের কথা চিন্তা করে কেঁদে বুক ভাসান তিনি । তারপরও বিয়ে হয়ে যায় তাঁর । উচ্চশিক্ষার চিন্তা বাদ দিতে হয় তাঁকে ।
স্বামী আব্দুল জলিলের সাথে সংসার করতে গিয়ে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে সুফিয়া খাতুনের । স্বামীর মধ্যে এক বিশাল মনের দুখী মানুষের সন্ধান পান তিনি । তিনি বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী তাঁর থেকেও অনেক বড় এতিম ।
হাজী আব্দুল জলিল ১৯৪৫ সালের ১ লা জানুয়ারি যশোর জেলার অভয়নগর থানায় জন্মগ্রহন করেন । গ্রামের নাম দেয়াপাড়া । তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তাঁর বাবা দলিল উদ্দিন আহম্মেদ ভয়ানক কালাজ্বরে আক্রান্ত হন । তাঁর মা ফাতেমা খাতুন রাতদিন স্বামীর সেবা করে নিজেও কালাজ্বরে আক্রান্ত হন । কালাজ্বরে তাঁর বাবার মৃত্যুর পরদিন, তাঁর মা আমেনা খাতুন নিজেও মারা যান । মায়ের লাশ জড়িয়ে থাকা শিশু আব্দুল জলিলকে অনেক কষ্টে আলাদা করতে হয় । পিতৃমাতৃহীন আব্দুল জলিল যশোরে তাঁর চাচার বাসায় আশ্রয় নেন । সেখানে তাঁরও কোন অভাব ছিল না । কিন্তু কোন কোন ঘটনায় তাঁর মনে হয়েছে, সত্যিই তিনি এতিম, বড় অসহায় তিনি ।
এই এতিম দম্পতির বিলাসবহুল দাম্পত্য জীবন শুরু হয় চট্টগ্রামে । আব্দুল জলিল শিক্ষকতা ছেড়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির চাকুরীতে যোগ দেন । সরকারি খরচে উড়োজাহাজে স্ত্রী সুফিয়া খাতুনকে নিয়ে সেখানে সরকারি বাসায় ওঠেন তিনি । এতিম হয়ে যে মানসিক গ্লানিতে তাঁরা দুজন ভুগেছেন, তাঁদের সন্তানেরা সেই গ্লানিতে ভুগবে না- এটাই তাঁদের প্রার্থনা । কিন্তু ভাগ্য বিমুখ । তাঁদের সকল আশা ভঙ্গ করে সুফিয়া খাতুন একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন ।
দ্বিতীয় সন্তানের সময় এতিম দম্পতি আরও অনেক বেশী সতর্ক হন । চিয়ারবানু নিজে মেয়ের সাথে চট্টগ্রামে থাকেন । শহরের নামকরা ডাক্তার অনেক আশাবাদী । স্বাভাবিক বাচ্চা হবে সুফিয়া খাতুনের । কিন্তু হিসাবে ভুল ছিল ডাক্তারের । প্রসব বেদনা ঠিকই ছিল, কিন্তু সেখানে জীবনের স্পন্দন নেই । পেট কেটে মৃত সন্তান বের করেন ডাক্তার । অনেক আগেই অপারেশন করার দরকার ছিল তাঁর ।
কয়েকদিন হোল সুফিয়া খাতুনের পেটের যন্ত্রনা কমে না । অপারেশনের ঘা শুকায় না । ডাক্তার বলেন আবার অপারেশন করতে হবে । দ্বিতীয়বার অপারেশন করে ডাক্তার অবাক হন । পেটের মধ্যে আগের গজ তুলা রয়ে গেছে । তখন সেলাই করার সময় কেউ খেয়াল করেন নি । ডাক্তার আবারও ভুল করেন । এবার সুফিয়া খাতুনের ইউরেটর কেটে ফেলেন তিনি । কয়েকমাস পর ডাক্তার জানিয়ে দেন, সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছেন সুফিয়া খাতুন । স্থায়ী রোগী হয়ে পড়েন সুফিয়া খাতুন ।
আব্দুল জলিল ১৯৭৭ সালের দিকে সৌদি পেট্রলিয়াম কোম্পানিতে চাকুরী নিয়ে যান । সুফিয়া খাতুন দেশে । ১৯৮০ সালের দিকে দেশে ফেরেন আব্দুল জলিল । যে টাকা তিনি দেশে পাঠান, তার বড় অংশ কথিত আত্মীয়স্বজন নষ্ট করেছে জেনে তিনি দুঃখ পান । বিদেশে যাবার সুযোগ থাকলেও অভিমান ভরে আর সেখানে যান নি তিনি । নিজের কাছে যা সঞ্চয় ছিল, তা দিয়ে যশোরে জমি কিনে একটি বাড়ি করেন তিনি । কিন্তু নতুন বাড়িতে উঠেই গৃহ নির্মাণ কর্পোরেশন থেকে তাঁর নবনির্মিত বাড়িটি নিলামের আদেশ পান তিনি । জানতে পারেন জমি বিক্রেতা গৃহনির্মাণ কর্পোরেশন থেকে ঋণ নেওয়া জমি তাঁর কাছে বিক্রি করেছে । আব্দুল জলিল আদালতে যাতায়াত শুরু করেন । আদালতে তাঁর পক্ষে রায়ও পান তিনি । কিন্তু গৃহনির্মাণ কর্পোরেশন সেই রায় মানে না । এক আতঙ্কের জীবন শুরু হয় জলিল দম্পতির । এক দিনের জন্যও বাড়ির বাইরে যেতে পারেন না তাঁরা । ভয় হয়, কখন তাঁদের বাড়িটি নিলাম হয়ে যায়, কখন বেদখল হয়ে যায় বাড়িটি। এ রকম একটি কঠিন দুঃসময়ে এই পরিবারের সাথে আমার পরিচয় ।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । আমার মার কাছে আমি জানতে চাই, তাঁর অপূর্ণ কোন ইচ্ছা আছে কিনা । তিনি জানান, তিনি ছোটকালে তাঁর মামাবাড়ি থাকতেন । তাঁর একটা মামাত বোনও আছে । কিন্তু যোগাযোগ নেই । আমি আমার মাকে নিয়ে মায়ের মামাবাড়ি ট্যাংরালি গ্রামে যাই । সেখান থেকেই আমি সুফিয়া খালার ঠিকানা পেয়ে যাই ।
আমি যখন সুফিয়া খালার বাড়িতে যাই, ততদিনে তাঁরা সকল মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন । অনেকটা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন তাঁরা । তাঁদের কাছে আত্মীয় মানেই এক একটা ধান্দাবাজ মানুষ । ধীরেধীরে খালা খালুর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে । তাঁরা আমাকে নিজের ছেলের মত গ্রহন করেন । খালু হাজী আব্দুল জলিল ২০১২ সালের ৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন । আমি নিজে ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছি । বাবার কিছু মনে নেই আমার । খালুর সাথে আমার পরিচয় না হলে, বাস্তবে বাবা কেমন হয়, বাবার ভালবাসা কেমন হয়, তা আমার নিজের কখনো জানা হত না ।
আমার সুফিয়া খালা ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন । তাঁদের জীবদ্দশায় আমি সব সময় তাঁদের নিজের সন্তানের মত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি । মহান আল্লাহ্ আমার খালা খালুকে বেহেশত নসিব করুন ।
আগামী ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে আমার খালুখালার স্মরণে অর্পন– দর্পন স্মৃতি ফাউনডেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘হাজী আব্দুল জলিল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’ এবং ‘সুফিয়া খাতুন শিক্ষাবৃত্তি’র শুভ উদ্বোধন করা হবে । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যশোরের জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার জনাব প্রলয় কুমার জোয়ারদার, বিপিএম (বার), পিপিএম এবং সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ আবু শাহীন উপস্থিত থাকার সম্মতি দিয়েছেন । তাঁদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
মহান আল্লাহ্ আমাদের চেষ্টা কবুল করুন ।
৯ ডিসেম্বর, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।