রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয় (দুই)
প্রকাশ: ০৫:০৮ পিএম, ৩ অক্টোবর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৫:১৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া । ইস্কাটন গার্ডেন রোডের বামদিকের রোড । মিন্টো রোডের তিন ও চার নম্বর বাংলোর মাঝামাঝি আমি । তিন নম্বর বাংলোর প্রাচীর সংলগ্ন একটি পুকুর । আমি পুকুর সংলগ্ন বাংলোর ভিতরটা দেখার চেষ্টা করি । এটা একেবারেই ঠিক নয় । অনুচিত আচরণ । আমি আসলে এই বাংলোর আলাদা কোন বিশেষত্ব আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করি । বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এই সময় মন্ত্রীরা সরকারি বাড়িতে উঠে এল, আমিও ঢাকার মিন্টো রোডে সরকারি ভবনে ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠলাম’ (পৃষ্ঠা ২৬৭) । তারমানে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হক সাহেব মন্ত্রিসভার সমবায় ও কৃষি উন্নয়ন দপ্তরের মাননীয় মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে মিন্টো রোডের এই অভিজাত এলাকায় একটি বাড়ি দেওয়া হয় । কিন্তু সেই সরকারি ভবন কোনটি ?
আমি ছেলেবেলায় শার্লক হোমস এঁর ভক্ত ছিলাম । শার্লক হোমসের ২২১বি, বেকার স্ট্রিট, লন্ডনের ঠিকানা আমার এখনও মুখস্থ । আমাদের গ্রামের ডাকঘর থেকে লন্ডনে চিঠি লেখা যায় কি-না এবং ডাকমাশুলের টাকাই বা কে দিবে – এসব চিন্তায় তখন আর চিঠি লেখা হয়নি । পরে জেনেছি শার্লক হোমস এবং তাঁর ঠিকানা সবই কল্পিত । স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস । এই পরিণত বয়সে ছেলেবেলার সেই কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসে । আমি মিন্টো রোডের সেই বাড়িটি খোঁজার চেষ্টা করি, যে বাড়ি তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বসবাসের জন্য দেওয়া হয় ।
আগেই বলেছি ইতিহাসের প্রতি তেমন শ্রদ্ধা -ভালবাসা আমাদের নেই । বাড়িটির ঠিকানা জানতে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলেছি আমি । কোন ফল হয়নি। তবে, গতকাল একজন জানান মিন্টো রোডের সেই বাসাটিই এই তিন নম্বর বাংলো । আমার কৌতূহল সেখানেই । তিনি কোন প্রমাণপত্র দিতে পারেননি । তবে, মিন্টো রোডের তিন নম্বর বাংলো বিষয়ে তিনি নিশ্চিত এবং বাংলোসংলগ্ন পুকুরে দেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে ছোটকালে গোছল করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাড়ির সামনে পুকুর থাকলে বাংলার যে কোন ছেলেমেয়ে গোছল করবে, এটাই স্বাভাবিক । এ বিষয়ে বাড়িটির আশেপাশে কোন কিছু উল্লেখ আছে কিনা- আমি দেখার চেষ্টা করি । সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি । তবে ভদ্রলোকের দেওয়া তথ্য সঠিক হলে, কয়েকদিনের ব্যবধানে হক সাহেবের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় । এ বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “রেনু (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল । ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে । ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম । রেনুকে বললাম, “ তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও” । তারমানে বঙ্গবন্ধুর পরিবার মাত্র কয়েকদিনের জন্য এই অভিজাত এলাকায় থাকার সুযোগ পান ।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই । কিন্তু ইতিহাসের একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার মনে হয় শেখ মুজিব পরিবারকে এই অভিজাত এলাকায় বসবাসের জন্য বাড়ি দেওয়া এবং কয়েকদিনের ব্যবধানে তাঁকে এই অভিজাত এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা, বাঙ্গালীর স্বকীয় ও স্বাধীন জাতিস্বত্বা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মাইলফলক হিসাবে কাজ করে । তবে ইতিহাসের সে আলোচনায় আমি পরে আসি ।
আমার পিছনে মিন্টো রোডের সেই পুকুর । তিন নম্বর বাংলো সংলগ্ন গ্রিল দিয়ে ঘেরা পুকুর । সামনে রাস্তার বিপরীতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল । কিছুকাল আগেও যার নাম ছিল রূপসী বাংলা হোটেল । আসলে হোটেলটির আদি নাম – ইন্টারকন্টিনেন্টাল । ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা রমনা পার্কের কোণ ঘেঁষে স্থপতি উইলিয়াম বি ট্যাবলার এঁর নক্সা অনুযায়ী নির্মিত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এ এলাকার আভিজাত্য বর্ধনের এক নতুন সংযোজন । অবশ্য ততদিনে এলাকার অভিজাত বাসিন্দাদের পালাবদল ঘটেছে । ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের সামরিক শাসনে ২২ পরিবারের জন্ম হয়েছে । দুই দেশের বৈষম্য তীব্রতর হয়েছে । এসব অবশ্য অনেক পরের কথা ।
আমার বাদিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের প্রাচীর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় , বারডেম জেনারেল হাসপাতাল । এসব ছাড়িয়ে বাদিকে হাঁটতে থাকি আমি । আমার সামনে ঢাকা ক্লাব । গেটের সামনে ক্লাবের লোগোসহ মুজিব শতবর্ষের লোগো লাগানো । ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১১ । আমি কিছুক্ষণ দাঁড়ায় । সেদিনের ইতিহাস স্মরন করার চেষ্টা করি ।
মিন্টো রোডসংলগ্ন অভিজাত এলাকার সাথে ঢাকা ক্লাবের সম্পর্ক বেশ নিবিড় । ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের আদেশ দেন । এই আদেশে পূর্ববাংলা এবং আসামকে নিয়ে একটি ভিন্ন প্রদেশ গঠন করা হয় । প্রাদেশিক রাজধানী হয় ঢাকা । একদিকে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ এঁর দাবী; অন্যদিকে সেদিনের অনুন্নত ঢাকায় শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের আকর্ষণ করার জন্যই মূলত ক্ষতিপূরণ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় মডেলে তৈরি । প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর স্যার পি এ হারটগ । প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের মিন্টো রোড সংলগ্ন অভিজাত এলাকায় রাখা এবং তাঁদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্যই ১৯১১ সালে ক্যালকাটা ক্লাবের অনুরূপ ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয় । ঢাকা ক্লাবে শুধুমাত্র অভিজাত ইংরেজ এবং ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের সদস্য করা হয় । ক্লাবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঢোকার সুযোগ থাকলেও; এ দেশের কোন মানুষ, এমনকি যে নবাব পরিবারের সম্পত্তির উপর ক্লাবটি গড়ে ওঠে, সেই নবাব পরিবারের কারও ঢাকা ক্লাবে প্রবেশাধিকার ছিল না ।
আমি ঢাকা ক্লাবের গেটে লাগানো মুজিব শতবর্ষের লোগোর দিকে তাকাই । আনাড়ি হাতে ছবি তুলি । আমার বাদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা রমনা পার্ক । করোনা মহাদুর্যোগে ভিতরটা জনমানব শুন্য । অন্যমনস্কভাবে তারও কিছু ছবি তুলি আমি । কিন্তু আমার মাথায় আবহমানকালের শাশ্বত এক বাঙালি মায়ের ছবি ঘুরপাক খায় । তাঁর বিয়ে হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে । পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছরে ছেলেমেয়ে হলেও স্বামীর প্রকৃত সংসার করা হয়নি তাঁর । স্বামী এখন দেশের মন্ত্রী । অভিজাত এলাকায় অনেক বড় বাংলো তাঁদের । তিনি এতকালের পুঞ্জিভূত আবেগ দিয়ে সাজাতে থাকেন সংসার । স্বামী তাঁর বিদেশ সফরে । স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী । ফিরে এসে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হবেন তিনি । কত সুন্দর সাজানো সংসার তাঁদের ! স্বামী তাঁর ঠিকই ফিরে আসেন । তবে মাথায় গ্রেফতারী পরোয়ানা । তখনই জেলে যেতে হবে তাঁকে । মাকেও ছেলেমেয়ে নিয়ে ছেড়ে যেতে হবে এই অভিজাত এলাকা । ছেড়ে যেতে হবে তাঁর একান্ত মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুন সাজানো সংসার !
মনোরম এই প্রভাতে কেমন এক আবেগ মনে ভর করে আমার । শাশ্বত বাংলার একজন পতিব্রতা গৃহবধূ মায়ের মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করি আমি ।
(চলবে )
ইস্কাটন, ঢাকা । ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ।