রাশেদুল ইসলাম
(তিন )
স্ববিরোধিতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৫ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ভারতীয় জনগণের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে হাত দিতে চান নি । বরং উন্নতি চেয়েছেন । এমনকি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সি বলবত রাখতে চেয়েছেন তিনি । এ বিষয়ে যুক্তি এ রকম যে, ভারতে ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানির নবযোগদানকৃত ইংরেজ কর্মকর্তাগণ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ভারতীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হবেন । তাঁরা কলকাতা মাদ্রাসা এবং সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করা এদেশীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কোম্পানিতে নিয়োগদানের মাধ্যমে প্রচলিত দাপ্তরিক ভাষায় ভারতে ইংরেজ শাসনকার্য চালিয়ে যাবেন । কিন্তু লর্ড মেকলে এই শাসন পদ্ধতির ঘোর বিরোধিতা করেন । তিনি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সির স্থলে ইংরেজী এবং শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজী করার পক্ষে জোরালো যুক্তি উত্থাপন করেন । লর্ড মেকলের সুপারিশ অনুযায়ীই লর্ড উইলিয়াম বেনটিংক এঁর শাসনামলে ‘ইংরেজী শিক্ষা আইন, ১৮৩৫’ পাশ হয় । এই আইন বলেই জেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক ইংরেজী শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয় (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)।
ব্রিটিশ ভারতে লর্ড মেকলে প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুদুর প্রসারী প্রভাব থাকলেও এর ভিত রচনা করেন লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস । লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮১ সালে কোলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন সত্য, কোলকাতা মাদ্রাসা থেকে ফার্সি এবং আরবী ভাষা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় তাও সত্য; কিন্তু তাঁর ফর্মুলা অনুযায়ী ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে আরবি ও ফার্সি ভাষা দুটি ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হতে থাকে । এই ভাষাগত বিভাজন ইংরেজের ’ ভাগ কর এবং শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন সহজ করে দেয় । উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজ শাসনের মূল নীতি ছিল ‘Divide and Rule’.’ ভাগ কর এবং শাসন কর’। এই ভাগটা মূলত হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে ভাগ । ইংরেজ মুসলমান মোগল সম্রাটের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় । ফলে ভারতে ইংরেজ শাসনের মূল প্রতিপক্ষ মনে করা হয় মুসলমানদের । তবে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে বাংলার নবজাগরণ ঘটে । ইতিহাসে এটা বাংলার রেনেসাঁ নামে খ্যাত ।
বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনার কথা বললে একজন ইংরেজ ধর্মযাজকের কথা না বললেই নয় । তাঁর নাম উইলিয়াম কেরী । ভারতে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার, সমাজ সংস্কার বিশেষ করে হিন্দু ধর্মে আবহমান কাল থেকে চলে আসা অমানবিক সতীদাহ প্রথা বাতিলের জন্য ‘বেঙ্গল সতী রেগুলেশন, ১৮২৯’ বলবত করণে উইলিয়াম কেরীর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে ।
বলা হয়ে থাকে ইংরেজ নিজেরা চার্চের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে ইতিহাসে সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে । কিন্তু নিজেরা চার্চের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেলেও, সেই চার্চের মিশনারিদের তারা সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে । এ বিষয়ে কেনিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা জোমো কেনিয়াত্তার একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে । তিনি বলেন,
‘মিশনারিরা যখন আসে, তখন আফ্রিকানদের হাতে ছিল জমি,
মিশনারিদের হাতে ছিল বাইবেল।
তারা আমাদের শেখায় কিভাবে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে হয় ।
আমরা চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করি; কিন্তু চোখ খুলি দেখি, আমাদের হাতে বাইবেল;
আর তাদের হাতে আমাদের জমি’ ।
কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারিদের ভূমিকা বোধহয় একটু ব্যতিক্রম । খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম কেরী ধর্ম প্রচারে ১৭৯৩ সালে সপরিবারে কোলকাতা আসেন । কোলকাতা এসেই তিনি বাংলা ভাষা শেখা শুরু করেন । কথিত আছে প্রভু যীশুখ্রিষ্ট বেথেলহেমের একটি ভেড়ার আস্তাবলে জন্মগ্রহন করেন । মা মেরী যেহেতু বিবাহিত ছিলেন না, এজন্য সমাজে যীশুখ্রিষ্ট ও তাঁর মাকে সমাজে অনেক লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হতে হয় । ফলে উইলিয়াম কেরীর মূল লক্ষ্যদল সমাজের লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত মানুষ । আমাদের সমাজে যারা ‘দলিত’ এবং মহাত্মা গান্ধী যাদের ‘হরিজন’ আখ্যা দেন- তারাই তাঁর লক্ষ্য । একজন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি হিসেবে উইলিয়াম কেরীর মূল দায়িত্ব ছিল তৃণমূল পর্যায়ের এ ধরণের অবহেলিত মানুষের কাছে তাদের নিজেদের ভাষায় যীশুখ্রিষ্টের বাণী পৌঁছে দেওয়া । বাংলা মুলুকে স্থানীয় মানুষের মূল ভাষা বাংলা । তাই ১৭৯৩ সালে কোলকাতা নেমেই উইলিয়াম কেরী বাংলাভাষা শেখা শুরু করেন ।
১৭৯৯ পর্যন্ত ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানি উইলিয়াম কেরীকে ভারতে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়নি। এ কারণে ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানির অধিক্ষেত্রের বাইরে কোলকাতা থেকে দূরে হুগলীতে তিনি ‘শ্রীরামপুর মিশন’ গড়ে তোলেন । হুগলী সেসময় ডেনমার্কের রাজার অধীনে ছিল ।
(চলবে)
৯ আগস্ট, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।