রাশেদুল ইসলাম
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানঃ একটি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমরা বড়রা সাধারণত স্বার্থপর। নিজের পরিবার,সংসার ও বউ ছেলেমেয়ে ছাড়া কিছুই বুঝিনে । দুনিয়ার আর কেউ জগত সংসারে টিকে থাকুক, আর না থাকুক- কিছুই যায় আসে না । শুধু আমি, আর আমার পরিবার সুখে থাকলেই চলে । এ ধরণের এক সংকীর্ণ চিন্তার বেড়াজালে আমরা আবর্তিত হচ্ছি যেন । কিন্তু মজার ব্যাপার, আমাদের ছেলেমেয়েদের চিন্তা কিন্তু এরকম নয় । তারা আমাদের বড়দের মত নয় । এ রকম একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হল আমার সেদিন; অর্পণ – দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন আয়োজিত ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ।
‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার সূচনাপর্ব অনুষ্ঠিত হয় যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় । ‘নিজে সৎকাজ করি এবং অন্যকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করি’ এই শ্লোগান নিয়েই জাগ্রত ঝিকরগাছা নামক একটি বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত আগ্রহী ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর তালিকা প্রস্তুত করে । তালিকাভুক্ত এ সকল ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ‘লকডাউনে আমার মা’ বইটি বিতরণ করা হয় । বইটি পড়ার জন্য একমাস সময় দেওয়া হয় তাদের ।
উল্লেখ্য, অন্যকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন’ এর আওতায় ‘আমিই পারি’ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে । বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, যেকোন ব্যক্তি মানুষের জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা সম্পূর্ণ সেই ব্যক্তির উপর নির্ভর করে । ফলে, যেকোন ছেলেমেয়ে নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে, যদি তার লক্ষ্যের দিকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে যৌক্তিক বিচারে তার সেই লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা শতকরা একশ’ ভাগ । তবে এই সফলতার কোন মূল্য থাকে না , যদি তার মধ্যে মানবিক কোন গুণ কাজ না করে, যদি তার মধ্যে দেশপ্রেম না থাকে বা তার মধ্যে পরিশুদ্ধ ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনাবোধ কাজ না করে । এসব বিবেচনায় ‘নিজে সৎকাজ করি এবং অন্যকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করি’ শ্লোগান দিয়ে শুরু হওয়া ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতা কাম্য সমাধান দিতে সক্ষম বলে আমরা মনে করি ।
‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতায় তালিকাভুক্ত ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রী ৩ টি বিভাগে বিভক্ত । ৬ষ্ট থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ক’, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ‘খ’ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্যদের জন্য ‘গ’ বিভাগ । এই ৩ টি বিভাগের মধ্য থেকে ৮৩ জন প্রতিযোগী ২৬ আগস্ট ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে । প্রত্যেকটি বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অর্জনকারী মোট ৯ জন বিজয়ীদের মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে পুরষ্কার বিতরণ করা হয় । পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যশোরের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) জনাব হুসাইন শওকত । এ ধরণের প্রতিভাবান কর্মকর্তা আমি কম দেখেছি । তিনি প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত ‘লকডাউনে আমার মা’ বইটির উপর নিজের তৈরি একটি প্রশ্নপত্র প্রোজেক্টরের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন । তিনি হয়ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারি ছাত্রছাত্রী বইটি সত্যই পড়েছে কিনা – তা পরীক্ষা করার জন্যই এমনটি করেন । কিন্তু প্রতিযোগী ছাত্রছাত্রীদের তাৎক্ষনিক স্বতঃস্ফূর্ত সকল প্রশ্নের নির্ভুল জবাব, আমন্ত্রিত অতিথিদের মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত জেলা শিক্ষা অফিসার জনাব একে এম গোলাম আযম জানান তিনি বইটি পড়েছেন । সুযোগ থাকলে তিনি নিজেও এ পরীক্ষায় অংশ নিতেন । অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব এসএম জিল্লুর রশিদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মাহবুবুল হক, অর্পণ-দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শারমিনা পারভিন, শিক্ষাবিদ ও কবি ডঃ সাঈফ ফাতেউর রহমানসহ স্থানীয় গণ্যমান্য অতিথিবৃন্দ । সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার ঝিকরগাছা পর্বের আহবায়ক খ্যাতিমান সাহিত্যিক জনাব হোসেনউদ্দীন হোসেন ।
জানা যায় অনুষ্ঠানে মোট উপস্থিতি সংখ্যা ২১৭ জন । ঝিকরগাছা দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা মিলনায়তনের মোট ধারণ ক্ষমতা ১৫৭ জন । শিক্ষার্থী ৮৮ জন সহ আমন্ত্রিত অতিথিদের আসন ব্যবস্থা মিলনায়তনের ভিতরে এবং ৬২ জনের আসন ব্যবস্থা বাইরে করা হয় । উপস্থিত ছাত্রছাত্রী এবং ২৭ জন স্বেচ্ছাসেবী তরুণতরুণীর শৃঙ্খলাবোধ ও অতিথিপরায়ণতা সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে ।
কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয়ঃ
১। ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার ঝিকরগাছা পর্বে পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজয়ীদের ৯ জনের মধ্যে ৮ জনই ছাত্রী অর্থাৎ মেয়ে । নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন,
‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব’ ।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যই ভবিষ্যতে শিক্ষিত মায়ের চাহিদা পূরণ করতে যাচ্ছে । দেশের শাসনকার্যের দায়িত্বে যারা আছেন, তাঁদের এখন অনেক বড় দায়িত্ব সুন্দর জাতি গঠনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা ।
২। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অনেক প্রতিযোগী আমাকে জানায় যে, ‘নিজে সৎকাজ করি এবং অন্যকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করি’ বাস্তবায়নে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করছে । তারা এ কাজে লেগে থাকতে চায় । তারমানে তারা আমাদের বড়দের মত স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হতে চায় না । তাদের এই ভালো হওয়া ও ভালো থাকার সদিচ্ছাকে লালন করার সুন্দর পরিবেশ দেওয়া আমাদের সংশ্লিষ্ট সকলের নৈতিক দায়িত্ব ।
৩। এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার ঝিকরগাছা পর্বে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ জন ছাত্রছাত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ছেলেমেয়েদের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার মানবিক গুণসম্পন্ন হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় । প্রতিযোগী ছেলেমেয়েরা দেশের যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মানসিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি ক্ষতিকর ভিডিও গেম ও মাদকাশক্তির মত খারাপ অভ্যাস না করে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারে ।
৪। ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতা ঝিকরগাছা পর্বের আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট জাগ্রত ঝিকরগাছার পরিচালক ও সদস্য পর্যায়ের তরুণ তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেনট বিষয়ে বাস্তব দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হয়েছে । এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী তরুণতরুণীরা সরকারের ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ।
৫। এ ধরণের প্রতিযোগিতা এসডিজি ৪ এ বর্ণিত শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্য যেমনঃ সবাইকে অন্তর্ভুক্তকরণ, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং সুনাগরিক হিসেবে জীবনব্যাপী শিক্ষা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ।
ঝিকরগাছা পর্বে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্রীর বাবা আমাকে টেলিফোন করেন । তিনি জানান তার মেয়ের উচ্ছলতা প্রকাশ তাঁকে ‘লকডাউনে আমার মা’ বইটি পড়তে আগ্রহী করে । বইটি তিনি পড়েছেন । তাঁর ইচ্ছে, শুধু তাঁর মেয়ে নয়, তিনি নিজেও আমাদের কাজের সাথে থাকতে চান । তাঁকে স্বাগতম ।
‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতার পরবর্তী পর্ব মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় অনুষ্ঠিত হবে ইনশাল্লাহ । সেখানে ৩৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৫০ ছাত্রছাত্রী এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে ইচ্ছুক বলে জানান হয়েছে । অর্পণ – দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে । মেহেরপুর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে যথাযথ সহযোগিতা পাওয়া যাবে - এ প্রত্যাশা আমাদের ।
দোয়া চাই সকলের ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ।