রাশেদুল ইসলাম
নিজেকে অভিজাত মনে হয়
প্রকাশ: ০৮:৫৫ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ১০:৫৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
আমি রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা । ইস্কাটনে থাকি । আগে মোহাম্মদপুরে ছিলাম । মহানগরীর মোহাম্মদপুর একটা মিশ্র জনপদ এলাকা । সেখানে টোকিও স্কয়ারের মত বিলাসবহুল বিপনীবিতান যেমন আছে; সেই বিপনীবিতানের সামনে শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক কোলাহলও আছে । রাস্তায় অত্যাধুনিক বিএমডব্লিও গাড়ি যেমন আছে; একইসাথে শ্রমিকের ঘামঝরানো ঠেলাগাড়ি, রিক্সা বা রিক্সাভ্যানও আছে । মানুষে মানুষে হাজার ব্যবধান থাকলেও, সেখানে সকলে একসাথে বসবাসের প্রানান্তকার একটা চেষ্টা আছে । কিন্তু ইস্কাটনের অবস্থা ভিন্ন । এখানে একটি সুউচ্চ বহুতল ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরকে আমার হংকং বা সিঙ্গাপুর মনে হয় । এই শহরে যে দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষও আছে -এখান থেকে তা বোঝার উপায় নেই । তাই, আলোঝলমল মহানগরীর দিকে তাকিয়ে আজকাল নিজেকে আমার কেমন যেন অভিজাত মনে হয় ।
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে রমনা পার্ক এখন বন্ধ । তাই পার্কসংলগ্ন মিন্টো রোড, বেইলী রোড, হেয়ার রোড আমার প্রাতঃভ্রমণ কেন্দ্র । এখানে আছে রাস্তার দুপাশে সারিসারি বৃক্ষরাজি, সবুজের সমারোহ, আর বিভিন্ন সুরের পাখির কাকলি । অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা নৈসর্গিক এই দৃশ্যে আমার মনে হয় স্বর্গের বাগানে আছি যেন । প্রাতঃভ্রমণে নিজেকে আমার কোন এক ঐতিহাসিক নাটকের নায়ক মনে হয় । আমি আবেগ আবিষ্ট হয়ে হাঁটতে থাকি ।
বাস্তবে ইতিহাস বা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে আমাদের তেমন কোন শ্রদ্ধা বা ভালবাসা নেই । তাইতো ‘মিন্টো রোড’ এর দেওয়ালে ‘মিন্টু রোড’ লেখা হয়েছে । মনে হয় পাশের বাড়ির কোন এক মিন্টুর নামে রাস্তাটির নামকরণ করা হয় । ইংরেজ লর্ড মিন্টো যে ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট ছিলেন- এই মিন্টু নাম দেখে তা বোঝার উপায় নেই । আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার কারণে ভারতের জয়পুর এবং পূর্ববাংলার প্রাক্তন রাজধানি সোনারগাঁর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান । একই শৈল্পিক কারুকার্যে নির্মিত ভারতের জয়পুর এখন বিশ্ব পর্যটক নন্দিত ‘পিঙ্ক সিটি’ । আর বাঙ্গালির শৌর্যবীর্যে খ্যাত ঈসাখাঁর রাজধানী সোনারগাঁ জরাজীর্ণ ইটের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি ধ্বংসস্তূপ মাত্র ।
আমি বোধহয় বিষয়ের বাইরে চলে গেছি । বলছিলাম আমার প্রাতঃভ্রমণের কথা । মিন্টো রোড, হেয়ার রোড বা বেইলী রোডের মত জায়গায় ইংরেজ আমলে আমার মত শ্যামলা মানুষের হাঁটার কোন অধিকার ছিল না । সুইপার, দারোয়ান বা বড়জোর এদেশীয় বাবুর্চিরা এই এলাকায় থাকতে পারত - তা শুধু সাদাবর্ণের অভিজাত ইংরেজদের একান্ত প্রয়োজনে । ঢাকাসহ পূর্ববাংলা কলোনি রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের প্রায় সকল ইংরেজ কর্মকর্তা এখানে থাকতেন । তবে, তাঁরা পূর্ববাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হলেও সাধারণ মানুষের সাথে তাঁদের কোন সম্পর্ক ছিল না ।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এ দৃশ্যের পালাবদল হয় । ইংরেজিভাষী ইংরেজদের জায়গায় আসেন উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিরা । তবে, উল্লেখ্য যে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সূত্রে অভিজাত শ্রেণির সংজ্ঞায় বেশ পরিবর্তন আসে । সে কারণে অনেক বাঙ্গালি অফিসার এখানে বসবাসের সুযোগ পান ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিন্টো রোড এবং তৎসংলগ্ন এলাকা মন্ত্রিপাড়া নামে পরিচিতি পায় । তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি বড় অংশ এই এলাকায় থাকেন ।
আমি রমনা পার্কের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে । আমার সামনে রাস্তার ওপাশে মিনটো রোডের বিলাস বহুল মন্ত্রিপাড়া । রাস্তার দুপাশে শতবর্ষের সাক্ষী সারি সারি বৃক্ষরাজি । পাখির কাকলী আর অনুপম সৌন্দর্যে ভরা এই নির্জন প্রভাত আমাকে প্রশ্ন করে, ‘শুধু কি কপালগুনে এই অভিজাত এলাকায় থাকা যায়’ ?
(চলবে)
ইস্কাটন, ঢাকা । ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ।