রাশেদুল ইসলাম
নাসির আর নেই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:২১ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভোরবেলায় গ্রামের ফোন । ওপাড়ার মিজানুর জানাল, নাসির মারা গেছে । আমার বন্ধু নাসির । মাত্র কয়েকদিন আগে নাসির আমাকে ফোন করে । অবসরে যাওয়ার পর আমি কি করছি - এটাই তার জানার বিষয় ছিল । আজ সংবাদ পেলাম সে মারা গেছে ।
কিছুক্ষন পর নুর ইসলাম ফোন করে । সেও নাসিরের মৃত্যু সংবাদ দিতে চায় ।
নাসির এবং নুর ইসলাম আমার প্রাইমারি স্কুল জীবনের বন্ধু ।
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে আমি প্রথম ছিলাম । নুর ইসলাম দ্বিতীয়, আর নাসির ছিল তৃতীয় । আমি তিনজনের মধ্যে ফার্স্ট । এ নিয়ে অনেক বিড়ম্বনার কথা আমি কয়েকবার লিখেছি ।
নুর ইসলাম অনেক আগে গ্রাম থেকে চলে যায় । আমার সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না তার । অনেক বছর পর তার ছেলে যখন পরীক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করে, জেলা প্রশাসকসহ অনেক ঊর্ধ্বতন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যেদিন তার মত গরীবের বাড়িতে অভিনন্দন জানাতে যান; সেদিনই সে আমাকে টেলিফোন করে । এর আগে কখনও সে আমার সাথে কথা বলেনি । তাতেই আমার মনে হয়, সেই প্রাইমারি স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার কথা সে মনে রেখেছে । সেদিনই আমি জানতে পারি, তার খালাসী জীবনের কথা । তার জীবনযুদ্ধের কথা । সে যে বেতনের কথা বলে, তা একজন পোশাক কারখানার কর্মীর থেকেও কম । একজন অতি স্বল্পবেতনে চলা একটি মালবাহী জাহাজের খালাসী হয়েও তার প্রতিযোগিতার কথা ভোলে নি সে । এ ধরণের অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা মানুষকে আমি সতত বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। আমার অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে, একবার খুলনায় গিয়ে খোলা মালবাহী জাহাজের পাটাতনে বসে খালাসী নুর ইসলামদের সাথে একবেলা খাওয়ার । কিন্তু ব্যাটেবলে মেলাতে পারিনি কখনও ।
আমি বলছিলাম বন্ধু নাসিরের কথা । সে কোথায় যেন লজিং থাকত । এসএসসি পাস করার পর সে গ্রামে চলে আসে । ব্যবসা বানিজ্য শুরু করে সে । কয়েক বছর আগে পাশের গ্রামে বাড়ি করে সেখানে চলে যায় । তবে বিভিন্ন অসুখের কারণে বিগত কয়েক বছর তার বেশ খারাপ যাচ্ছিল । তবে আমার সাথে সব সময় তার যোগাযোগ ছিল ।
গ্রামে দিন মজুর শ্রেণির অনেক বন্ধুবান্ধব আছে আমার । তাদের সাথেও আমার যোগাযোগ আছে। আমার এক বোনের শ্বশুর বাড়ি পাশের জেলার মনোহর পুর গ্রামে । আমি মায়ের সাথে ছেলেবেলায় কিছুদিন আমার বোনের বাড়ি ছিলাম । সেখানকার এসবিজিএম প্রাইমারি স্কুলে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই । ক্লাসে ২০/২৫ জন ছেলেমেয়ে । তাদের মাধ্যে একজনের নাম সুশীল । সে মুচিপাড়ার ছেলে । এ কারণে ক্লাসের এক কোণায় ছোট একটা বেঞ্চে তাকে আলাদা বসতে দেওয়া হত । সুশীলের সেই একা বসে থাকার ছবি আমার মনের মধ্যে স্থায়ী দাগ কেটে আছে । সুশীলের দুই ছেলে- সুদেব ও বাসুদেব । তাদেরও ছেলেমেয়ে আছে । এই সুশীল যে আমাকে বন্ধু বলে, এটা নিয়ে আমার কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের ঘোরতর আপত্তি ছিল । এতে তাঁদের সম্মানের হানি হয় বলে জানান তাঁরা ।
আমাদের সমাজে মানসম্মানের বিষয়টি অনেক বড় ব্যাপার । কিন্তু কিসে মানুষের মানসম্মান বাড়ে বা কমে তার সুনির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড নেই । যে যার মত মানসম্মান গেল গেল বলে চিৎকার করে । তবে আমার নিজের এ বিষয়ে একটা ব্যাখ্যা আছে ।
আমি যেদিন সহকারি সচিব হিসেবে সচিবালয়ে যোগদান করি, তখন থেকেই আমার এলাকার মানুষ আমাকে সচিব হিসেবেই পরিচয় দেন । কিন্তু বাস্তবে সচিব হিসেবে কেউ জন্ম নেয় না । সেও একজন সাধারণ শিশুর মত জন্ম নেয় । হাজার রকম মানুষের সাথে মিলে মিশে সচিব বা আরও বড় কোন পর্যায়ে তাকে আসতে হয় । জীবনে চলার পথে ভিখিরি, পানবিড়ির দোকানদারসহ হাজারো পেশার মানুষের সাথে তার পরিচয় হয় । জীবন পথে চলার কোন এক পর্যায়ের একজন মানুষ যখন তাকে ভাই বা বন্ধু বলে পরিচয় দেয়, তখন কি সে অন্যায় করে ? আর ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে তা স্বীকার করা সম্মানের, না অসম্মানের ? সত্য কথা স্বীকার করাটা আমি নিজে সম্মানের মনে করি । তাই সকলের সাথে আমার পুরানো সম্পর্ক আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরনে রাখার চেষ্টা করি ।
অবশ্য এক্ষেত্রে আমার মায়ের ভূমিকা ছিল মুখ্য । আমার মা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু বোবা ছেলেমেয়ের কথা মা যেমন বোঝেন, মা যদি বোবা হন, বা খুব গুছিয়ে কথা বলতে না পারেন, ছেলেমেয়েরাও কিন্তু মায়ের সব কথা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে । ধর্ম ও সমাজের সবকিছু নিয়ে আমার মায়ের একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল । মা বলতেন, ‘মানুষ সব সমান । কোন মানুষকে কখনও অবজ্ঞা করবা না । সব মানুষের মুখ আল্লাহ নিজের হাতে তৈরি করেছেন । তাই কখনও কাউকে ‘তোর মুখে লাথি মারব’ এ রকম কথা বলবা না’ । মা তাঁর মণের গভীর বিশ্বাস থেকে কথাগুলো বলতেন । কেন যেন মায়ের সেদিনের কথাগুলো আমার মনের বিশ্বাসের সাথে একাকার হয়ে আছে ।
আমি বলছিলাম নাসিরের কথা । আমার বন্ধু নাসির গতকাল রাত ১০ টায় মারা যায় । আজ সকাল ১০ টায় তার দাফন হয়েছে । করোনাকালে মৃত্যু একটা সাধারণ ঘটনা । কিন্তু যাদের একান্ত আপনজন মারা যায়, শুধু তারাই বুঝতে পারে, কি অপূরণীয় ক্ষতি হোল তাদের ।
মহান আল্লাহ নাসিরের বেহেস্ত নসিব করুন ও তার পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দিন । আমিন ।
২৯ জুন, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।