রাশেদুল ইসলাম
অকামের মানুষ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ জুন,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৩৬ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
লোকটি আমাদের গ্রামের । আমার সাথে বয়সের ২/৩ বছর পার্থক্য হবে । একসাথে বড় হয়েছি । গ্রামে বড় হওয়া নিয়ে একজন বিখ্যাত কবির কবিতার দু’লাইন নিম্নরূপ-
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
একসাথে খেলি আর পাঠশালা যাই।
এভাবে একসাথে বড় হলে যে কোন মানুষকে ভাই বা বন্ধু বলা যায় । মোটেও দোষের কিছু নয় । লোকটি তাই বলেছে । তার মালিক অডিট বিষয়ে কাজ করেন । ঢাকা শহরে কয়েকটি বাড়ি আছে তাঁর । এসব দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার রেখেছেন তিনি । আমার গ্রামের লোকটি সেই কেয়ারটেকার । তিনি যখন শুনেছেন আমি তাঁর কেয়ারটেকারের বন্ধু; প্রথমত তাঁর বিশ্বাস হয়নি । এত উচ্চপদের মানুষ কিভাবে একজন কেয়ারটেকারের বন্ধু হয় ? তবে যখন নিশ্চিত হয়েছেন, তখন আমার সাথে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে বলেন তিনি । আমি যে কোন একদিন তাঁকে আমার অফিসে নিয়ে আসতে বলি । কিন্তু তিনি সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় চান । আমি তাঁকে সেভাবেই আসতে বলি ।
কারো রেফারেন্সে কেউ দেখা করতে চাইলে, আমি তাঁকে একটু বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকি । কারণ এ বিষয়ে আমার নিজের একটা করুণ অভিজ্ঞতা আছে । জুনিয়র অফিসার থাকা কালে আমি আমার একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে পাঠাই । কিন্তু সেই সিনিয়র অফিসার আমার শিক্ষককে তাঁর রুম থেকে বের করে দেন । এ বিষয়ে পরে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁর বিনা অনুমতিতে কক্ষে প্রবেশ করার কারনেই তিনি তাঁকে বের করে দিয়েছিলেন । এ বিষয়ে আমার শিক্ষক নিজে আমাকে কখনও কিছু বলেননি । কিন্তু সেই অপমানের জ্বালা এখনো আমার বুকে দগদগে ঘায়ের মত রয়ে গেছে । তাই যে কেউ পূর্ব পরিচয় বা অন্য কোন সুত্রে আমার কাছে পাঠালে, আমি তাঁকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি । কারণ কেউ যখন কোন একটা সূত্রে কাউকে কারো কাছে পাঠান, কোন একটা অধিকার বলেই তিনি তা করে থাকেন। তাই সেই পাঠানো লোকটার প্রতি সৌজন্য প্রকাশ না করে যদি অপমান করা হয়; তখন সেই অপমান লোকটাকে যিনি পাঠিয়েছেন, প্রকারন্তরে তাঁর দিকেই যায় ।
আমার গ্রামের লোকটির রেফারেন্সে ভদ্রলোক যথাসময়ে আমার অফিসে দেখা করেন । তিনি তাঁকে অডিটের কাজ দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ জানান । আমি তাঁকে জানাই, তাঁর মত অভিজ্ঞ মানুষ আমাদের অফিসের সাথে কাজ করবে এটা সৌভাগ্যের ব্যাপার । তবে কাজ পাওয়ার জন্য সরকারি সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে; সেগুলো তাঁকে অনুসরণ করতে হবে । আমি তাঁকে যথাযথ আপ্যায়ন করে বিদায় দিই । তিনি খুশী হয়েই চলে যান বলে মনে হয় । কিন্তু পরে জেনেছি, তিনি আমার উপর মোটেও খুশী হননি । তিনি ফিরে গিয়ে তাঁর কেয়ারটেকারকে অনেক গালিগালাজ করেছেন । তাঁর অভিযোগ কেয়ারটেকার ইচ্ছে করেই আমার মত একজন অকামের মানুষের কাছে তাঁকে পাঠিয়েছে। কেয়ারটেকার যত বলে, তিনি নিজের ইচ্ছেই গিয়েছেন; ততই তিনি রেগে আগুন হয়ে যান । এখন সেই কেয়ারটেকারের চাকরি যায় যায় অবস্থা ।
এক সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে ছিলাম আমি । সেখানে একদিন ওকালতি গাউন পরা এক ভদ্রলোক আমার সাথে দেখা করেন । তিনি একটা প্যাকেজ প্রস্তাব নিয়ে কথা বলেন । তিনি জানান, বিগত সরকারের আমলে অন্যায়ভাবে তিনি চাকরিচ্যুত হন । এখন উচ্চ আদালতের রায় পেয়ে তিনি চাকুরীতে পুনঃবহালের আবেদন করেছেন । এ বিষয়ে তিনি আমাকে একটি প্যাকেজ প্রস্তাব দিতে চান । আমি তাঁকে জানাই, বিষয়টি খুবই সাধারণ । তাঁর আবেদনের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হবে । মতামত তাঁর পক্ষে হলে, অবশ্যই তিনি তাঁর চাকুরী ফিরে পাবেন । তিনি বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে । একারণেই এটা প্যাকেজ প্রস্তাব’ । আমি তাঁকে জানাই, আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাঁর নিজের । আর আমার কাজের জন্য তাঁর কোন প্রোগ্রাম নেওয়ার দরকার নেই । ভদ্রলোক একটি হাসি দিয়ে চলে যান । তাঁর সেই হাসি আমাকে বুঝিয়ে দেয়, আমি একটি অকামের মানুষ । তবে যথানিয়মেই ভদ্রলোক তাঁর চাকরি ফেরত পান এবং পরবর্তীতে আরও কয়েকবছর চুক্তিভিত্তিতে চাকরি করার সুযোগ হয় তাঁর ।
আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ । আমার কাছে এলাকার মানুষের অনেক প্রত্যাশা । সেটাই স্বাভাবিক । কিন্তু এলাকার মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারিনি আমি । সে বিচারেও একজন অকামের মানুষ আমি ।
সংসারযাত্রা নির্বাহের ক্ষেত্রে আমার ব্যর্থতা আরও অনেক বেশী । আমার মা চেয়েছেন তাঁর ছেলে সৎ জীবনযাপন করুক । আমার স্ত্রীও চেয়েছেন আমি যেন কখনও কোন অসৎ আয় উপার্জন না করি । আমার চাকুরীর প্রথম জীবনে আমার শিশু পুত্রের দুধ কেনার আর্থিক সামর্থ আমার ছিল না । আমার স্ত্রীকে সে সময় রাতদিন পরিশ্রম করতে হয় । অত্যাধিক পরিশ্রমে এক সময় তিনি কঠিন অসুখে পড়েন । সেই অসুখের জের এখনো কাটাতে পারেননি তিনি । আমার সেই ছেলেটিও আজ বেঁচে নেই । আমি নিজে সংসারমুখী হলে হয়ত এসব দুর্ঘটনা এড়ানো যেত । এসব বিচারে আমি সত্যিই একজন অকামের মানুষ ।
তবে একজন মানুষের জীবনে শুধু ব্যর্থতা থাকে না; অনেক সফলতাও থাকে । আমার চাকুরী জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা, চাকুরীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ভাবে চাকুরী করেছি আমি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে মানুষ যে যেভাবে থাকতে চায়, মহান আল্লাহ তাকে সেই ভাবে রাখেন । আমার ক্ষেত্রে এটি শতভাগ প্রমাণিত সত্য । আমি সৎভাবে চাকরি করতে চেয়েছি । আমি জীবনের ৩১ বছরের বেশী সময় সরকারি চাকরি করেছি । এই দীর্ঘ সময়কালে কেউ আমাকে অসৎ হবার জন্য বলেননি বা বাধ্য করেননি । যে সকল মন্ত্রণালয় বা সংস্থায় কাজ করেছি আমি, সেখানে আমার পর্যায়ের সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে কাজ করার সুযোগ হয়েছে । আমার সর্বশেষ কর্মস্থলের মাধ্যমেও বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশী অনুদান লেনদেন হয়ে থাকে । কিন্তু কোথাও আমাকে কেউ অসৎ হতে বলেননি । আমি সব সময় সকলের সাথে ভাল ব্যবহার করেছি । সাধ্যমত মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি ।
আমার সরকারি চাকুরী জীবনের শেষ কর্মদিবস ছিল ২ জুন, ২০২১ । সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে আমাকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হয় । এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পিপিপি এর নির্বাহী প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক এবং মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির ভাইস চেয়ারম্যান আমাকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে সম্মানিত করেন । তাঁদের সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ব নাম সংস্থাপন মন্ত্রণালয় । এই মন্ত্রণালয় থেকেই আমাকে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয় । এই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর আমি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করি । মানুষ মাটি থেকে জন্ম নিয়ে যেমন জীবন শেষে মাটিতেই ফিরে যায়; ঠিক তেমনি একই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চাকুরী জীবন শেষে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (গ্রেড ১) হিসেবে আমি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফিরে এসেছি । চাকুরী বিধি অনুযায়ী এখান থেকে পরবর্তী এক বছর আমাকে বিনা পরিশ্রমে পূর্ব নিয়মে বেতনভাতাদি প্রদান করা হবে । তারপর পরিপূর্ণ অবসর ।
কিন্তু আমার বাস্তবতা ভিন্ন । আমি কাজ থেকে কখনও অবসর চাইনে । মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করতে চাই আমি । তাই লেখালেখি ও ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতা আয়োজনের পাশাপাশি আরও কিছু কাজ চাই আমি । মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ । মহান আল্লাহ কবুল করলে একটা কিছু জুটে যাবে ইন শা ল্লাহ ।
আমার নতুন জীবন শুরুর এই দিনে যারা আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।
মহান আল্লাহ কবুল করুন ।
৫ জুন, ২০২১ । ইস্কাটন , ঢাকা ।