জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাংলার কুরুক্ষেত্র
প্রকাশ: ১১:৩০ পিএম, ১৮ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কুরুক্ষেত্রই বটে। যে কায়দায় জনপদে হুংকার ছড়ানো হচ্ছে তাতে সরলমনা বাঙালীর উঠান বেশ উত্তপ্তই বলা চলে। তবে এই উত্তাপের আঁচ কিন্তু অন্য রকম। নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে আজকের দিনের পশ্চিম বাংলার নির্বাচনী প্রচার প্রচারনা। কেউ বলছেন জয় বাংলা এবং সঙ্গে বন্দে মাতরম। কেউ লাফাচ্ছেন জয় জয় হরে হরে বিজেপি বাংলার ঘরে ঘরে। এবং লম্বা করে একটি মৌলবাদী শ্লোগান - জয় শ্রী রাম। অন্যরা বলছেন মেহনতি মানুষ জিন্দাবাদ। লাল সেলাম ইত্যাদি। জোটবদ্ধ অন্য সঙ্গী বলছেন ভারত মাতা কি জয়। তাদেরই আরেক সহযোগী বলছে লিল্লাহে তকবীর। তবে সব কথার শেষ কথা হোল “এই পিয়ারি ভারত মা তুঝে – ম্যেয় শির ঝুকাতি হ্যায়.................। অর্থাৎ জয় হিন্দ।
পশ্চিম বাংলায় একবিংশের এই নির্বাচনী প্রস্তুতি বেশ যুদ্ধংদেহী কায়দায় এগিয়ে চলেছে। একুশের এবারকার বিধান সভার নির্বাচনে তিনটি পক্ষ নির্বাচনী ময়দানে মাঠে নেমেছে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন পক্ষ বলছে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার গল্প। বলছে, বাংলা তার মেয়েকে চায়। মা মাটি ও মানুষের গল্প বলে তারা বাঙালীর দরজায় কড়া নাড়ছে। সর্ব ধর্মের জয়গান গেয়ে তারা বাংলাকে ধর্ম নিরপেক্ষ আবেগে লালনের মন্ত্রে এগিয়ে চলেছে। ঘাসে উপর জোড়া ফুল তাদের নির্বাচনী প্রতীক। অর্থাৎ মাটি বা তৃনমুলের সাথে সংযোগকে এই প্রতীক দিয়ে বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ দিল্লি শাসনের ধর্মের আশ্রয়ে পথ চলার দল। হিন্দু ও হিন্দুস্থানের একাত্মতার আবেগে বাঙালীকে এক করার প্রচেষ্টায় তারা গলদগর্ম হচ্ছে। বাংলার উঠানে এক নতুন শ্লোগান “জয় শ্রী রাম” এর উলুধ্বনি দিয়ে তারা বাঙালীর ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে এগোতে চাচ্ছে। পদ্মফুল তাদের নির্বাচনী প্রতীক। পদ্মফুল হচ্ছে হিন্দু দেব দেবির জ্ঞানের প্রতীক। বিজেপি হিন্দু ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করে বিধায় ধর্মীয় রীতি ও আচারের উপকরনের এই ফুলকে তারা নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছে। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ও তেলেস্মাতি কান্ড ঘটেছে ওই শিবিরে যখন দেখা যায় ভারত মাতা কি জয়ের রূপকার কংগ্রেস, নাস্তিক সাম্যবাদের বামপন্থিরা এবং লিল্লাহি তাকবিরের এক ধর্মগুরুর আখড়া এক মঞ্চে দঁড়িয়ে একুশের বাংলায় নির্বাচনী যুদ্ধে একাট্টা হয়ে নির্বানচনী জোট গঠন করে। তাদের যৌথ নির্বাচনী প্রতীক জানা না গেলেও কাস্তে হাতুড়ি ও হাত প্রতীকই তাদের নির্বাচনী প্রতীক হবে বলে ধারনা করা যায়। কেননা তাদের আরেক শরীক ফুরফুরার পীর সাহেব কেন্দ্রিক আইএসএফের প্রতীক এখনো প্রকাশ্য নয়। কেননা ওটা রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে পরিচিত নয়। কাস্তে হাতুড়ি কৃষক ও শ্রমিকের হাতিয়ার। বামপন্থীরা মেহনতি কৃষক শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে বিধায় এই কাস্তে হাতুড়ি তাদের নির্বাচনী প্রতীক। অপরদিকে হাত হচ্ছে স্বাধীনতা ও ক্ষমতার প্রতীক। এটা কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক।
এভাবেই চলছে ভারত মাতার বাংগাল রাজ্যের একুশের বিধান সভার নির্বাচনী কৌশল ও তার প্রচার প্রচারনা। ধর্মীয় রাজনীতির চাষবাস এই রাজ্যে কোনদিন ছিল বলে মনে পড়ছেনা। তবে বৃহত্তর ভারতবর্ষ যখন ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে দুটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপ নিল তার সূচনা লগ্ন থেকেই ধর্মীয় আবেগের এক নির্লজ্জ মঞ্চায়ন এতদাঞ্চলের মানুষ দেখেছিল। প্রশ্ন আসতে পারে দুটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলা হচ্ছে কেন? স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর হবে সাম্প্রদায়িক তকমা নিয়ে মুসলিম প্রাধান্যে পাকিস্থানের সৃষ্টি হলেও অবশিষ্ট ভারত কিন্তু হিন্দু প্রাধান্যেই তার রাষ্ট্র কাঠামো ধরে রাখলো। যদিও তা ঘোষনায় উহ্য থাকলো কিন্তু হিন্দু কৃষ্টি ও কালচারের সমন্বয় ঘটিয়েই হিন্দুস্থান বা ভারত রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকলো। সময়ের আবর্তে আজকের দিনে তাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে ভারত নামক এই সর্ব ধর্মের রাষ্ট্রে। সংখ্যা গরিষ্ঠের সুবিধাভোগে হিন্দু ধর্মীয় প্রাধান্যের জয়ধ্বনি দিয়েই ভারত রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। ফলে ধর্মীয় আবেগের প্রকাশ্য আচরনে আজ ভারতীয় ঐতিহ্যের “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম সবকো সৎমতি দে ভগবান.........., ঈশ্বর আল্লাহ তেরা নাম সবকো সৎমতি দে ভগবান” আজ আলনায় তুলে রাখা বাপুজির বাণী হয়েই রয়ে গেল। রাম-রহিম-জন-ভিক্ষুদের ভারত এখন প্রচন্ড আবেগ ও উদ্দীপনায় “জয় শ্রীরাম” ধ্বনি দিয়ে “রাম রাজত্ব” পত্তনের দিকে ধাবমান।
স্বাধীন ভারত বর্ষের পৌঁনে এক'শ বছরের ইতিহাসে এত সাধু সন্যাসী বা কপালে রক্ত তিলক ও গায়ে গেরুয়া জড়ানো সংস্কৃতি গত দশ বছরে যেভাবে সেদেশের অলিগলিতে উপচে পড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেভাবে পুজা অর্চনার ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে এতে করে কোন সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ এটাকে নিয়ে প্রমাদ না গুনে পারেন কি? একথা বলতে দ্বিধা নেই যে ভারত এখন তার সৃষ্টির সূচনা লগ্নের সেই সর্ব ধর্মের অবারিত চলাফেরার সেক্যুলার রাষ্ট্রের মৌলিকতায় নেই। যে ভারত তার অহিংসা পরম ধর্মের মূলমন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ভারত এখন নিত্যদিনের হিংসা ও সাম্প্রদায়িক জিঘাংসায় জর্জরিত। রাজনীতির সুসংগঠিত সদাচারে ভারত একসময় পাশ্ববর্তী ও গনতান্ত্রিক অভিযাত্রায় চালিত রাষ্ট্র সমূহের কাছে ঈর্ষার পাত্র ছিল। আজকের দিনে সেই ভারত এখন হিংসা বিদ্বেষ, ধর্ম নিয়ে হানাহানি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ধর্মকে নিয়ে এগিয়ে চলার মহোৎসবে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের “হিন্দু রাষ্ট্র” গঠনের মহা পরিকল্পনায় তারা ধর্ম তত্ত্বের রাজনীতিকে হাতিয়ার বানিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা কেন্দ্রীয় শাসনের ছড়িটা হাতে নিয়েও ফেলেছে।
সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে রাজনীতির সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত জাতিগত রাজ্যগুলিতে ধর্মীয় গোঁড়ামীর রাজনীতি পায়ের মাটি খুঁজে না পাওয়াতে দিল্লি শাসনের ব্রাহ্মন্যবাদী শাসকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পশ্চিম বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাইতো দেখি পশ্চিম বাংলার বিধান সভা নির্বাচনের এবারের আসরে ভারত বর্ষের তাবড় তাবড় রথী মহারথীরা এখন বাংলায় হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার খায়েসে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। ভারত বর্ষের স্বাধীন স্বত্ত্বার গনতান্ত্রিক আচরনে এমন মারমুখি ও ধর্মীয় উস্কানীর নির্বাচন ভারতবাসী এর আগে কোন রাজ্যে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। তাইতো বিদগ্ধজনেরা এবারের পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভার নির্বাচনী ময়দানকে কুরুক্ষেত্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দুর্যোধন দুঃশাসনরা এখন সদলবলে গেরুয়া চাদরে ঢেকে ফেলতে চাচ্ছেন বাংলার পঞ্চ পান্ডবদের। স্বাধীনচেতা বাঙালী তার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অমিত তেজ এবং তার বাঙালী স্বত্ত্বার দ্যুতি নিয়ে এখনো শিরদাঁড়া উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয়। যদিও নিজ উঠানকে মজবুত রাখার মানসে আজ তারা এক ত্রিশংকু অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
একদিকে সর্ব ভারতীয় ব্রাহ্মন্য অবয়বের হিন্দু মৈলবাদী আচরন আর অন্যদিকে ধুতি পৈতার মাড়োয়ারী আচারে বাংলার উঠানকে “রাম নবমী”র কৃষ্টি কালচারে একাকার করে ফেলার এ এক প্রচ্ছন্ন হুমকি বলেই সাধারন বাঙালী মনে করছে। আজ বাংলার বাঙালীয়ানা সত্যিকার অর্থেই সর্ব ভারতীয় উঠানে জিম্মি হয়ে পড়েছে। নইলে যখন টিভির লাইভ প্রচারে ধর্মীয় মোড়কের দলটি দিল্লির কেন্দ্রীয় অফিস থেকে রাজ্যটির স্থানীয় বিধান সভার নির্বাচনে তাদের প্রার্থী ও নির্বাচনী এলাকার নাম ঘোষনা করছিলেন সে সময় ঘোষকের ভিন্ন ভাষায় নির্বাচনী এলাকা ও প্রার্থীর নামের বিকৃত উচ্চারন প্রতিটি বাঙালীকে পীড়া দিয়েছিল বলেই মনে হয়। আদর্শ ভারতীয় সাজার ইঁদুর দৌড়ে কতিপয় মোটাতাজা বাঙালী বাবু যখন ওইসব রামজি শ্যামজি মাড়োয়ারীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে জয় জয় হরে হরে করে বাঙালীকে বিভ্রান্ত করেন তখন তাদের মাঝে সাতচল্লিশের শ্যামা প্রসাদ ও তাদের উত্তরসুরী বর্তমানের ভগত সিংদের প্রতিচ্ছায়া দেখা যায়।
যে আয়োজনে আজকে বাংলার নির্বাচনী কুরুক্ষেত্র তার মঞ্চায়নে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার দুর্ভাগ্যজনক ফ্যাক্টর হচ্ছে ওবিসি/ এসটি/এসসি গ্রুপ। জাত পাতের ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজে বিভাজনের এই অবহেলিত হিন্দুরা সব সময় হিন্দু ব্রাহ্মন্য আনুকুল্যে তাদের সমাজ বদ্ধতা ও চেতনাবোধে লালিত হয়ে থাকেন। মনুষ্য সৃষ্ট ধর্মীয় নিগ্রহের এই সম্প্রদায় ধর্মীয়ভাবে ব্রাহ্মন কায়স্থ গোত্রীয় হিন্দুদের সেবকের অনুগ্রহে সমাজবদ্ধ হয়। তারা ভারতের মোট হিন্দুর পঞ্চাশ শতাংশের কম নয়। ধর্মীয় চেতনার অংশ হিসাবে তারা ব্রাহ্মন সম্প্রদায়কে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবেও মান্যি করেন। ফলে বিভাজনের এই লক্ষণ রেখায় সিংহভাগ ওবিসি এসটিরা “কর্তার ইচ্ছায় কর্ম” ভেবে তাদের জীবন বোধের উঠান সাজান। তারা সব সময় অবহেলিত এবং সামাজিকভাবেও কম গুরুত্ত্বের হয়ে থাকে বলে ওই সম্প্রদায়কে নিয়ে ব্রাহ্মন্য ঠাকুররা তাদের ক্ষমতার দন্ডে সব সময় সুবিধাজনক ভাবেই বিচরন করেন। তবে পশ্চিম বংগের জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত বাঙালী সব সময় রাজনীতি সচেতন। ধর্মীয় উস্কানী তাদেরকে মাঝেমধ্যে এলোমেলো করে দিলেও সময়ে তারা সঠিক সিদ্ধাতেই এগিয়েছেন। সর্ব ধর্মের সবস্থানে বাঙালী তার ঐতিহ্যে অটুট থাকবে বলেই বিজ্ঞজনেরা মত দিয়ে থাকেন। ধর্ম দিয়ে নয়, জাতিগত ঐতিহ্যের জয়গানেই বাঙালী তার রাজনৈতিক সচেতনেতার স্ফুরন ঘটাবে এবং এটাই একুশের বিধান সভার নির্বাচনী প্রতিপাদ্য হবে বলে বিদগ্ধ জনেরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ঘোষপাড়া, রাজশাহী, ১৮ মার্চ,২০২১।