জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভাই
প্রকাশ: ০৯:০৯ পিএম, ২৪ জানুয়ারী,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৩৮ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ভাই শব্দটি বড়ই মিষ্টি। মিষ্ট ভাষের এই “ভাই” শব্দে সহজেই সবকিছু সামাল দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়। ভাই শব্দটি কবে থেকে আমাদের এই সমাজ ও জনপদে শুরু হয়েছে তা জানা না থাকলেও এই ভাইয়ের উৎপত্তি সংসারের গন্ডি থেকে শুরু তা কিন্তু চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। ইদানীংকার “ভাই” সংস্কৃতি বড়ই গোলমেলে ও ভীতি সঞ্চারের এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবহমান কালের ভাই সংস্কৃতি হচ্ছে এক ভরসা ও ভালবাসার মেলবন্ধন। বড় ভাই ছোট ভাইয়ের সামঞ্জস্যতায় যে যার নিজস্ব অবস্থানে ভালবাসা বা স্নেহ আদরের এক মিশেল অনুভুতির নাম হচ্ছে ভাই। ভাই যেমন সংসারের গন্ডিকে আবদ্ধ ক'রে এক সুশীল সহবস্থানের ডাক তেমনি পাড়া মহল্লায় এই ভাই ডাক এক শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে বিদ্যমান। বাংলার সমাজ ব্যবস্থার “ভাই” ডাকের এই ছোট্ট শব্দটি আস্থা ও ভালবাসার প্রতীক। সমাজ সংসারে ভাই শব্দটি সুবিচারের বা যুথবদ্ধ হয়ে লড়াই করার প্রতীক হয়ে শাশ্বত কাল হতে আমাদের আশ্বস্ত করেছে, সমাজবদ্ধ করেছে এবং সর্বোপরি ভালবাসার আস্থা হয়ে স্বস্তি দিয়েছে।
আজকের দিনে ভাই সম্বোধনের পিছনে রয়েছে রাজনীতির আধিপত্য ও সমাজে কর্তা হয়ে বেড়ে উঠার এক প্রান সঞ্চারী রসদ। সত্তর দশক থেকে শতাব্দী শেষের মুহূর্ত পর্যন্ত “ভাই” শব্দটি ছিল এক আতংকের নাম, ভীতির নাম। সরকার রাজনীতি ও সমাজ নীতির পাশাপাশি এই “ভাই” শব্দটি নিজস্ব স্টাইলে এক প্যারালাল অনুশাসনের প্রতীক হিসাবে বিরাজ করতো। সে সময় অন্ধকার জগতের এই “ভাই”য়ের হুকুমে সমাজের গতি প্রকৃতি এলোমেলো হয়ে যেত। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে কিংবা দেশের ব্যবসা বানিজ্যের রোজনামচা ওইসব ভাইদের “ভাইচারে” অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিবেন? বাড়ী বানাবেন? কিংবা সামাজিক কোন আচার অনুষ্ঠান করবেন? ব্যাশ! সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু ভাইচারের নিয়মাচারে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট থেকে আপনার অনুষ্ঠানের শুভারম্ভের বোতাম টিপুন। সব ঠিকমত হয়ে যাবে। কোন উটকো ঝামেলা নেই। সামাজিক নিরাপত্তার পুরোটাই আপনাকে আশ্বস্ত করবে। নির্বিঘ্নে আপনি আপনার সামাজিক ও পারিবারিক চাহিদায় চলাফেরায় স্বাচ্ছ্বন্দবোধ করবেন। কিন্তু একটু এধার ওধার হয়েছে তো সর্বনাশ। রাষ্ট্রীয় কোন সহযোগিতাই আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী সুখ ও স্বস্তিতে রাখতে পারবে না। সে যেন এক অলিখিত “ভাইচারের” সমাজ লিখন ছিল সে সময়ের “ভাই” বা “দাদাগিরির” অনুশাসনে। এবং তা অবশ্যই অদৃশ্য যমদূতের হুংকারের মতই।
ব্যবসা বানিজ্যের ব্যক্তি মালিকানাধীনই হোক বা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের অংশ হোক - তাতে কোন কিছুই যায় আসে না ওই ভাই নামের অন্ধকারের অলিখিত ভাইচারের অনুশাসনে। টেন্ডার হোক কিংবা সরবরাহ হোক সবখানেই ভাইদের ভাইগিরির অলিখিত এক শ্বেতপত্র সর্ব উঠানে সরল গতিতে চলমান ছিল। এই ভাই বাহিনী তাদের নিজস্ব স্টাইলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে জুজু হয়ে স্বপ্রতিভ ছিল। সে সময় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোন মেকানিজমই সেই ভাইচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে তাকে উচ্ছেদ বা নির্মুলের কোন পর্যায়ে ছিল বলে মনে হয়নি। এক অসহায় আত্ম সমর্পনের উঠানে আমাদের সমাজ সংসার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তখন এভাবেই চলমান ছিল। তবে ব্যতিক্রম যে ছিল না তা কিন্তু নয়। সেক্ষেত্রে রক্তক্ষরনের এক মিশেল আতংকে সে সবের সমাধানে রাষ্ট্র যন্ত্রকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সমাজে ঘৃণিত বা নিষিদ্ধ এই ভাইচারের ভাইয়েরা অদৃশ্য শক্তি হয়ে এক অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সামাজিক নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারের কিছুটা প্রতিচ্ছটা সে সময় অবশিষ্ঠ ছিল বলেই হয়তো সেই সব রাম রাজত্বের ভাইয়েরা ততটা প্রকাশ্য হতে পারেনি। তবে রাজনীতির দুর্বিনীত আচরনের স্নেহাশীর্বাদ নিয়েই হয়তো ওই ভাইয়েরা একটু বেশীই বেপরোয়া হতে পেরেছিল বলে বিশিষ্ট জনেরা বলে থাকেন।
নতুন শতাব্দীতে রাজনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্টে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিতে বিশ্বাস সহমর্মিতা এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধে চিড় ধরা শুরু হয়। রাজনীতির মানবিক মুল্যবোধের আদর্শগত স্থান কক্ষচ্যুত হয়ে ব্যক্তি ও গোষ্টী দ্বন্দ্বে আসক্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতি বিত্ত বৈভব অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হওয়া শুরু করে। ফলে রাজনীতির নৈতিক অবস্থানে গন সম্পৃক্ততার বিষয়টি গৌন হয়ে পড়ে। রাজনীতির উঠানে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ সহমর্মিতা মানবিক মুল্যবোধ এবং নৈতিকতা আজ কচু পাতার ফোঁটা জল হয়ে প্রকাশ্য হয়ে বিচরন করছে। ফলে কথিত “ভাইচারের” সেই নিষিদ্ধ উচ্চারনের “ভাই” শব্দটি আজ রাজনীতির উঠানে স্বতঃসিদ্ধতা পেয়েছে। রাজনীতি তার শাখা প্রশাখার অংগ সংগঠনের মাধ্যমে “ভাই” সৃষ্টির অলিখিত অনুশীলনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। যে ভাই এক সময় অন্ধকারের নিষিদ্ধ উচ্চারনের আতংকের নাম ছিল সেই ভাই এখন রাজনীতির পরম চাহিদার এক সম্মুখ সারির যোদ্ধা হয়ে সম্মানিত উচ্চারন। এই ভাইয়েদের হাতেই এখন রাজনীতির ব্যাটন। এই ভায়েরাই তো সময়ের আবর্তে সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে সামনের সারিতে জায়গা পাচ্ছেন। বলা যায় রাজনীতির দৈউলিয়াত্ব আজ এই দুর্বিনীত “ ভাইচারের” দৌরাত্বে অসহায় আত্মসমর্পন করে করে বসে আছে। রাজনীতি এখন চলে এই কর্তৃত্ববাদী “ভাই” সংস্কৃতির আচরনে। অবশ্য রাজনীতির বড় ভাইয়েরা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বড় বড় সীলমারা পদ ও পদবীর আধিকারিকদের নাম কদাচিত শোনা গেলেও রাজনীতির কাঠামোগত ঐতিহ্যে সেসব নাম বৈতরনীর বাইরেই থেকে যায়। সমাজ ও জনপদে তাদের ভাইচারের উচ্চারন অদৃশ্য ছায়া হয়েই অন্তরালে অবস্থান করে। ফলে সাধারন জনগন টিন এজার কিংবা রাজনীতির নেতৃত্বের মোহনায় অবস্থান নেয়া ফ্রন্ট লাইনের “ভাই” দের ভারেই ভারাক্রান্ত থাকে। গ্রাম গ্রামান্তরে, গঞ্জ, ঘাট ও বন্দরে কিংবা পাড়া ও মহল্লায় রাজনীতির গজিয়ে উঠা এইসব পরাক্রমশালী ভাইদের “ভাইচার” যেভাবে “নীলকুঠি” কায়দায় রাজনীতির মোড়কে গোটা বাংলায় প্রকাশ্য হয়েছে তাকে কোন ব্যাখ্যায় বর্ননা করা যায় তা বলা মুস্কিল। তবে ছাত্র বা যুব রাজনীতির দৌর্দন্ড প্রতাপশালী সেই “ভাই”টি যখন মুল রাজনীতির কাঠামোয় “আমুক ভাই” বা “তমুক ভাইয়ের” তকমা নিয়ে পদাধিকারী হন তখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সেই অঙ্গটি বা অঙ্গ সমূহ এক অলিখিত “ভাইচারে”র নিত্যসঙ্গী হয়ে প্রকাশিত হয়। এই “ভাই”সাবদের মিশেল ভাইচারে যখন রাজনীতি মহাজনী কায়দায় মধ্যযুগীয় সেই রাজা মহারাজা বা জমিদারী স্টাইলে তাদের পাইক পেয়াদা বা চেলা চামুন্ডাদের মাধ্যমে জনপদে ভীতি ছড়িয়ে বা শক্তি প্রয়োগে তাদের ক্ষমতার দন্ডটি উঁচু করে ধরে তখন ওইসব বড় ও ছোট ভাইয়েদের মিশেল শোরগোলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক মধ্যযুগীয় আবহের সুত্রপাত হয়। এখনকার সময়ে ভাই মানেই সমাজপতি। ভাই মানেই সামাজিক খড়্গ। ভাই মানেই দূরে থাকার প্রস্তুতিতে সাধারনের তটস্থ থাকা। ভাই মানেই সামাজিক কাঠামোগত আত্মসমর্পনের নাম। ভাই মানেই রাজনীতির দুরাচারী “দৌড়ের” নাম। তাইতো “ভাই” আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় এক ভয়ংকর অথচ শক্ত পিলারর নাম।
বলেছিলাম “ভাই” একটি সম্মানের নাম। আছে কি? হাঁ আছে। তবে অন্যভাবে। ভাই একটি স্বস্তি ও আশ্রয়ের নাম। সেটাও অন্যভাবে। ভাই এক সমীহ জাগানো শ্রদ্ধার নাম, ভালবাসার নাম, যুথবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার নাম, প্রশান্তির নাম। ভাইয়ের সংজ্ঞায় উচ্চারিত সমস্ত বিশেষনই ভাইয়ের সামনে ও পিছনে বিদ্যমান। কিন্তু আজকের একবিংশের উঠানে “ভাই” আজ অন্য বিশেষনে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যমান। এই ভাইয়েদের দাপটে বাংলার জনপদ আজ তটস্থ। কেননা এই ভায়েরা রাজনীতির মাসলম্যান। আজকের ছন্নছাড়া বিবেকহীন রাজনীতি এই ভাইদের মুষ্টিবদ্ধ পেশী শক্তিতে বলীয়ান। তাইতো এইসব ভাইয়েদের অন্ন যোগানে আজ হাড় জিরজিরে বাঙালী ফোকলা দাঁতের কাষ্ঠহাসিতে জয় ও জিন্দাবাদের শ্লোগানে জর্জরিত।
রাজশাহী, ২৩ জানুয়ারী,,২০২১।