বাংলাদেশের সবচেয়ে ছদ্মবেশী পাখি কোনটি? এর চোখে কি আগুন জ্বলে?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ অক্টোবর,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:১৬ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
শারদীয় পূর্ণিমার রাত। চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। উছলে পড়া আলোর বন্যায় ভেসে যেতে চায় মন। ভ্যাপসা গরম।
ঘরেও তাই মন বসে না। মেঠোফুলের মাতাল সুবাস, কাঁচা ঘাসের সুবজ গন্ধ, কোন ছেলেবেলার সেই সোনালি দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তাই গাঁয়ের পথে হাঁটছি, সেই মায়াভরা রাতে। দুপাশে ঘন ঝোপের বেড়া।
চাপ চাপ অন্ধকার জাপটে বসে আছে ঝোপগুলোকে। চাঁদের আলো ঢুকতে পারে না সেই অন্ধকারে। তাতে বরং ভালোই হয়েছে। জোনাকিরা ভিড় করেছে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি মাঠের আরও গহিনে। রাস্তার কোলঘেঁষে একটা বাঁশের মাচা করে রেখেছেন কেউ একজন। মাচাটা তেঁতুলগাছের নিচে। জমাট অন্ধকারে ছেয়ে গেছে তেঁতুলগাছের মাথাটা। পূর্ণিমার আবছা আলো, নির্জন মাঠ, তেঁতুল গাছ- সব মিলিয়ে বুক কাঁপানো একটা ব্যাপার।
তেঁতুল পাতার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আসছে চিলতে জোছনা।
তক্ষকের ডাক শুনি। ঝিঁঝি পোকার ঐকতান অবিরাম। রাতজাগা পাখিরা ডানা ঝাপটায়। ক্রার-র-র ক্রার-র-র করে। অন্ধকারের আড়াল থেকে ডেকে ওঠে খুঁড়লে পেঁচা। ঠিক তখনই শুনি সেই ভয়ানক ডাক! কলজে কাঁপানো! কত রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে রতচরা পাখির এই ডাক। পাশের কোন ঝোপের ভেতর থেকে ডেকে ওঠে একবার...দুবার...তিনবার… একটানা...।
হঠাৎ এই ডাকে ভড়কে গিয়েছিলাম। কত বছর পরে এই ডাক শুনছি, ঠিকঠাক সময়ের হিসাব দিতে পারব না।
ছেলেবেলায় গভীর রাতে ডেকে উঠত রতচরা পাখি। কখনো একটা, কখনো একজোড়া। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেত ওদের ভয়ানক ডাকে। ট্রাউউ…ট্রাউউ…ট্রাউউ! রাতের নৈঃশব্দতা বিদীর্ণ করে সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ত লোকালয়ে। ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম। বড়রাও ভয় পায় এ ডাক শুনে। লোকে বলে আতস পাখি। রাতে ওদের চোখ দিয়ে নাকি আগুন বেরোয়। তাই নিয়ে জন্মেছে কত ভয়ধরানো গল্প, কত কাল্পনিক ইতিহাস!
রাতে চাষাদের মাঠে কাজ থাকে মাঝে মাঝে, নানা কারণে। কেউ কেউ নাকি অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে দুটি আলোর বিন্দু। আসলে রতচরা পাখির চোখ। অন্ধকারে চোখে আলো পড়লে সব রতচরা প্রাণীরই চোখ জ্বলে। মাঝরাতে মাঠে ঘুরে বেড়ানো চাষি টর্চের আলোয় হয়তো সেই চোখই দেখেছে। সেটাই ফুলে-ফেঁপে ভয়ানক রূপ নিয়েছে।
এই পাখির একটা ছবি তুলেছিলাম একদিন। গাঁয়ের গোরস্থানের পাশে একটা বাঁশঝাড়ের নিচে। সেখানে একটা লেজঝোলা পাখি শাহবুলবুলকে দেখেছি, বাঁশপাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়তে। গোরস্থানটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। হাতে ক্যামেরা, তাই কষ্টেসৃষ্টে উঠতে হলো পাঁচিলের ওপর। ইতিউতি করে অনেক খুঁজলাম। শাহ বুলবুলের দেখা আর পেলাম না। হতাশ মনে নেমে পড়ছি পাঁচিলের ওপর থেকে; চোখের কোণে ধরা পড়ল ক্ষীণ একটা নড়াচড়া। চোখ নামালাম নিচের দিকে। তখনো নড়ছে, শুকনো আম আর বাঁশপাতার জটলায় কী যেন! একেবারে খুদে কিছু নয়। কিন্তু কী?
চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারছি না! মাথাটা খারাপ হলো নাকি! হঠাৎ শিহরণ উঠল গায়ে। সাপ দেখলে এমন শিহরণ ওঠে। একই রকম অনুভূতি। আবছাভাবে মনে হলো, একটা অজগর সাপ বুঝি কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। নড়াচড়া তো করল কয়েক সেকেন্ড। আবার চুপচাপ। সাপ কিনা তাও বুঝতে পারছি না। তবে কিছু একটা তো বটেই। ঝাড়া তিন মিনিট লাগল বুঝতে। অজগর নয়। রাতচরা পাখি। ছদ্মবেশ ধরার ওস্তাদ।
মা পাখি আর দুটি ছানা শুয়ে ছিল গায়ে গা ঘেঁষে। হঠাৎ আরামে ব্যাঘাত ঘটছিল বোধহয় একটা ছানার। তাই নড়ে উঠছিল সে বেচারি। ভাগ্যিস নড়েছিল। তা না হলে এ জীবনে এ পাখির ছবি তোলার আর সুযোগ হতো না হয়তো। পাঁচিল ঘুরে গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম গোরস্থানে। ছবি নিতে নিতে এগোলাম পাখিগুলোর দিকে। ওদের কোনো হেলদোল নেই। পরোয়াই করছে না আমাকে। আসলে আমি যে ওদের দেখতে পেয়েছি, এটা ওরা বোঝেনি।
আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। হাত দুয়েকের ব্যবধান মোটে। ওরা ভাবছে শুকনো বাঁশপাতার সঙ্গে যেভাবে মিশে গেছে, কেউ ওদের খোঁজ পাবে না। ক্যামেরার সামনে ঘাস লতা সরানোর চেষ্টা করছিলাম, তখনই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল মা পাখি। ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়ল। তিনজন তিন দিকে। একটা ছানা বেশিদূর যায়নি।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে এদের কম খুঁজিনি। আমাদের একটা বাঁশবাগান ছিল আগে। একদিন ভর-দুপুরেই ভয়ংকর সুরে ডাকছিল একটা পাখি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করেছিলাম সেটাকে। সেদিন থেকেই চিনি এই রাতচরা কিংবা আতস পাখিকে। মা আর দাদি বলতেন, ওদের নাম দিনকানা। রাতে চরে বেড়ায় আর দিনে চোখে দেখে না বলেই এমন নাম। তথ্যটা বোধহয় ভুল। দিনে চোখে দেখে। তবে রাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। দিনে পড়ে পড়ে ঘুমায়, শুকনো পাতার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে। এরাই হলো বাংলাদেশের পাখির জগতে সবচেয়ে বড় ছদ্মবেশী। কতটা ছদ্মবেশী, ওপরের ছবিটা দেখলেই বুঝবেন।