avertisements 2

রাজনীতির ধর্ম বনাম ধর্মের রাজনীতি

লালসালু'-র মজিদ ও তার অন্ধ অনুসারীদের খপ্পরে দেশ

মাহবুবুল আলম
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ অক্টোবর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:০২ পিএম, ২০ জানুয়ারী,সোমবার,২০২৫

Text

সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্ম উৎসব  দুর্গাপূজার  মণ্ডপে কুরআন রাখা কে কেন্দ্র করে মুসলিম ধর্মান্ধগোষ্ঠী কর্তৃক অস্থিতিশীল পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে তথ্যপ্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল অংশ – তিনি বিশ্বাস করেন না যে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এবং আমাদেরকে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতেই হবে। তার বক্তব্যের মূল স্পিরিট বা চেতনা  হল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল থাকলে দেশের ধর্মান্ধরা ধর্মকে পুজি করে যে ধর্ম উত্তেজনা ছড়ায়, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে  সেটা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। এটা তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। যদিও বর্তমানে সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' আছে, তিনি মনে করেন এটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে তিনি যে কোনো ধরনের পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারেন। জনগণের সমর্থন থাকলে  তিনি সেই পরিবর্তন করতে পারেন। এটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ। এটা রাজনীতির একটা ধর্ম।
মুসলিম ধর্মান্ধগোষ্ঠী ছাড়া তার এই বিশ্বাসের সাথে কেউ দ্বিমত করবে না। কিন্তু কথা হল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেই কি ধর্মান্ধরা ধর্মকে পুজি করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করবে না? অতীত ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।
একইভাবে ধর্মান্ধরা রাজনৈতিক দল গঠন করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে তারাও সংবিধানের যেকোনো ধরনের পরিবর্তন করতে পারে। তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করতে পারে। বাংলাদেশকে  ইসলামিক রিপাবলিক করতে পারে। শরিয়া আইন চালু করতে পারে। কিন্তু তারা ভাল করেই জানে ধর্মকে ব্যবহার করে তারা কোনদিনই রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারবে না। আর এই জন্যই তারা ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। এটা ধর্মের রাজনীতি।
ধর্মীয় রাজনীতির  বিভিন্ন দিক আছে। যেমনঃ যে মুসলিম ছেলেটি মাজারে কুরআন শরীফ রেখে আসলো সে যে কোরআনের অবমাননা করল এটা কেউ বলছে না। হিন্দুদের পূজা মন্ডবে কুরআন রাখায় যে হিন্দু ধর্মকে অবমাননা করা হলো এটা কেউ বলছে না। পূজা মন্ডপে কুরআন শরীফ রেখে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীর অনুভূতিতে যে আঘাত করা হলো এটা কোন মুসলিম বলছে না। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়! মুসলিম ধর্মান্ধরা শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারে সজাগ, অন্য কোন ধর্মের মানুষ তাদের কাছে মানুষ নয়। সত্যি কি তাই! যদি থেকে থাকে তাহলে আমাদেরকে বলুন আমরাও আপনাদের সাথে আছি।

ধর্ম নিয়ে অনাদিকাল থেকে রাজনীতি চলছে তো চলছেই। কেউ মূল প্রসঙ্গে কথা বলে না। কেউ বলে না এর মূল সূত্রপাত কোথায়। এ ধর্মান্ধতাকে সমাজ থেকে কিভাবে মূল উৎপাটন করা যায় এই ব্যাপারে কেউ কথা বলছে না।

আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশিরভাগই এতিম ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা করে। সেখানে তারা বিনামূল্যে থাকা এবং খাওয়ার সুবিধা ভোগ করে। এতে করে তাদেরকে ধর্মের নামে যেটা শিখানো হয় তারা সেটাই শিখে। ভালো মন্দ বিচার করতে শিখে না। ভালো মন্দ বিচার করতে পারে না। কিছু কিছু ধর্মপ্রাণ পিতা-মাতাও তাদের সন্তানদেরকে এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ ব্যয় করে পড়ান। তারাও  একই রকম অন্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। ফলাফল- ধর্মীয় উন্মাদনা, নিজ ধর্মের বাইরে অন্য সবাইকে 'মানুষ' মনে না করা।

পৃথিবীতে কয়েকটি দেশ ছাড়া আর কোথাও ধর্মীয় অন্ধ শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। একদিকে  প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অন্ধ-ধর্ম গোষ্ঠী তৈরি করা আরেকদিকে তাদেরকে দমন করা এই বিপরীতমুখী রাজনীতি থাকলে সমাজ থেকে কখনোই এই সমস্যার সমাধান হবে না। 

সরকার হয়তো মনে করে ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে চুপচাপ রাখতে পারলে রাজনীতির লাভ হবে। হচ্ছেও তাই। কিন্তু অন্তিমে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি  দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ, অবৈধভাবে অর্থ- সম্পদ উপার্জনকারি ও প্রবাসীগন সবাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থ দান করে থাকে।  মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও বিভিন্ন সংস্থা তো আছেই। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন অর্থ দান করে থাকে পরকালে বেহেশত লাভের আশায় আর  ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকারী দান করে থাকে পাপ মুক্তির আশায়। আর এই অর্থ গ্রহণ করে যারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তারা ইহকাল এবং পরকাল – দুই কালেরই ফায়দা হাসিল করছেন।

এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা  আপনাকে-আমাকে বলে নবী (সঃ)-র মত সাধারণ জীবন যাপন করতে বলে। ধর্মের নামে অর্থ দান করতে বলে। অথচ তারা কিন্তু ঠিকই শত শত বিঘা জমির মালিক। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় এদের ফ্লাট-বাড়ি আছে। এরা যখন ওয়াজ করে প্রতিরাতে ২০০০০/৫০০০০/লক্ষ টাকা চার্জ করে। হেলিকপ্টারে চড়ে ধর্ম প্রচার করে। তারা তাদের মাদ্রাসা-মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও দান করেন না। কারণ একটাই আরো বেশি করে অনুদান আনা।

সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে সেটা সরাসরি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির হাতে না দিয়ে সরকার যদি এখানকার এতিম ছেলে-মেয়েদের জন্য কর্মমুখী কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তবে তা দ্বারা সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জনবল বাড়ানোর জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এতিমদের জন্য এই ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কিনা আমার জানা নাই।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এতিমদের জন্য বিভিন্ন রকম অর্থ বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে থাকে (https://msw.gov.bd/)। সেটা সম্ভবত পর্যাপ্ত নয়।

আমরা প্রায় দেড় কোটির মতো প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছি। সরকারি-বেসরকারি দেশী বিদেশী সংস্থার সহযোগিতা পাশাপাশি আমরা যদি প্রত্যেকেই একজন করে এতিম শিশুর দায়িত্ব নিতে পারি তাহলে সমাজ থেকে এই সমস্যার সমাধান  কিছুটা হলেও হতে পারে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ

আমি ধর্মীয় এতিমখানায় অনেক বছর ধরে নিয়মিতভাবে টুকটাক দান করতাম। তারপর এলাকায় গিয়ে একটু খোজ খবর নিলাম-ওরা  এতিমখানা থেকে পাশ করে কি কাজ করে। দেখলাম যে, ওরা বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করে, এতিমখানায় কোরআন শিক্ষাদেয়। এর বিনিময়ে মানুষের দান দক্ষিনা নিয়ে জীবন যাপন করে। তখন আমি ভাবলাম আমিতো সমাজের জন্য অনুৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী তৈরিতে সহায়তা করছি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম ওই এতিমখানা মালিকের বাড়িঘর ও সে নিজে বেশ স্বাস্থবান। খোঁজখবর নিয়ে আরও অনেক কিছু জানলাম। আর তখন থেকেই আমি ওখানে অর্থদান বন্ধ করে দিলাম।

আমি ব্যক্তিগতভাবে গত ১১-১২ বছর যাবত ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তৈরিতে তেমন অর্থদান করিনি। কয়েকজন ছেলে মেয়েকে জীবনমুখী শিক্ষা অর্জনের জন্য সহায়তা করেছি।তাদের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। আমি মনে করি ‘মুসলমান’ হওয়ার আগে ‘মানুষ’ হওয়া জরুরী।‘মানুষ’ হওয়া কঠিন, ‘মুসলমান’ হওয়া সহজ। 

মাহবুবুল আলম, মেলবোর্ন, অষ্ট্রেলিয়া। ২৩শে জুন ২০২১

avertisements 2