avertisements 2

বিদেশ সচিবের প্রথম সফর :ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের সমীকরণে চীনের অবস্থান

তাপস দাস
প্রকাশ: ১১:৫৭ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৫:১০ এএম, ২৩ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

বিশ্ব রাজনীতিতে যেকোন দেশের বিদেশ সচিবের প্রথম বিদেশ সফর বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। সেক্ষেত্রে ভারতের নতুন বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শৃংলার বাংলাদেশে তার প্রথম সফর শিক্ষা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বাংলাদেশের ভূ -কৌশলগত অবস্থান এশিয়ার দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন এবং ভারতের কাছে ভূ -রাজনৈতিক ও ভূ -অর্থনৈতিক কারণে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে।বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থান করছে তাছাড়া বানিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাংলাদেশের ভূ -কৌশলগত অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার ভূমিকাকে প্রসারিত করেছে।সাম্প্রতিক বিদেশ সচিবের বাংলাদেশে ঝটিকা সফর নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে চীন কী  বাংলাদেশে তাদের সমাজতান্ত্রিক উপনিবেশ স্থাপনে বেশ সক্ষম ? এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পশ্চাদপদ কিনা?

 

একথা সত্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলা,ব্যবসা -বাণিজ্য ,কৃষি ,শিল্প এবং প্রতিরক্ষার খাতে চীনের সহযোগিতা আগের তুলনায় সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতি মধ্যে শাহজালাল সার কারখানা ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কাজ দুদেশের সহযোগিতায় এই  নির্মাণ প্রকল্পগুলি  শেষ হয়েছে । চীনের উদ্যাগে এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাঙ্ক প্রথম দফায় যে সমস্ত ঋণ দিয়েছে ,সেগুলির মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের আপামর  জনগণ উপকৃত হবে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর চীন ৯৭%শুল্ক মুকুব করেছে। বাংলাদেশের পাটজাতীয় পণ্যও চীনের বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। 

 

কিন্তু খুব সম্প্রতি গত ১৫ই আগস্ট যেই দিনটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয় সেই দিনে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনে উপহার পাঠিয়ে চীন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের ক্রোধের শিকার হয়েছে। তাছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন পরিকল্পনা এবং চট্টগ্রামে নিউমুরিং পরিকল্পনার কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলাম এবং বেগম জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেওয়ার কেলেঙ্কারিতে চীনের কোম্পানি হারবার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছে যা চীন এবং বাংলাদেশের সম্পর্কে একটি অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়েছে। 

 

অন্য দিকে ভারত -বাংলাদেশের সম্পর্কে গত ৫ বছরে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে যা দুদেশের সুসম্পর্কেরই বাতাবরণ করছে। ২০১৫ সালে ৪১ বছর ধরে চলমান সমস্যা দুদেশের পূর্ণ সহযোগিতায় ছিট মহল সমস্যার সমাধান হয়েছে যা দুদেশের আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি নজির সৃষ্টি করেছে। ভারত সাফটা চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের কাছে বিশাল বাজার উন্মুক্ত করেছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশী রপ্তানিকারকদের অ্যালকোহল  এবং তামাক ছাড়া শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে যা প্রায় ৪২.৯১%। 

 

তাছাড়াও উত্তর -পূর্বাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনা সরকার ভারতকে পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছর দুদেশের সম্পর্ককে সাম্প্রতিক কালের বিচারে “সোনালী অধ্যায়” বলে ঘোষণা করা হয়েছে দুদেশের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি ঈদ উপলক্ষে ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত যাত্রী সরবরাহে সাহায্য করার জন্য ১০ টি লোকোমোটিভ উপহার হিসেবে প্রদান করেছে। 

 

চীন বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন মহলে ভারতের বিদেশ সচিবের এই বাংলাদেশ যাত্রাকে চীনের এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির প্রসঙ্গ টেনে চীনকে এগিয়ে রাখছেন ।তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন "চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা করা উচিত নয় ,কারণ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ব্যবসায়িক ,অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক রক্তের সম্পর্ক।  

 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি প্রবাদ আছে "একটি দেশ তার বন্ধু পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়" ফলে শুধু বর্তমান সম্পর্কে ভিত্তিতে নয় আগামী দিনেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি সহ বিশ্বরাজনীতিতে একে অপরের প্রয়োজন।বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্ননয়ের ধারা বজায় রাখতে হয়তো চীনের অর্থলগ্ন বাংলাদেশকে আকর্ষিত করছে। তবে শেখ হাসিনার মতো বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেত্রী  শ্রীলঙ্কা ,আফ্রিকা সহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের আগ্রাসন এবং নীতি সম্পর্কে যথেষ্ট অকিবহল। 

 

তবে এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের সঙ্গে যখন ভারত এবং চীনের সম্পর্কের কথা উঠে আছে তখন সেটি শুধু মাত্র বৈদেশিক নীতিতেই থেমে থাকে না। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সময় থেকেই ভারত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং চীন তার বিপক্ষে অবস্থান করেছিল । শুধু তাই নয় বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং মুজিব হত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে চীন গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সুতরাং ভারতের পক্ষ থেকে যেটা নজর রাখা প্রয়োজন চীন যাতে  বেশি বাংলাদেশের জনগণের মননকে নিজের পক্ষে নিতে নাপারে। কারণ চীনের বাংলাদেশে প্রতিপত্তি ভারত বিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের শক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে  ভারতকেও সতর্ক থাকতে হবে যাতে ভারতের কোনো  অভন্তরীন নীতি বাংলদেশের মধ্যে থাকা বিরোধী শক্তিকে শক্তিশালী  না করতে পারে।

 

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং চিত্রপরিচালক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তান, চীন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কখনও বিজয়ী হতে পারত না, যদি না শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণ আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান না করত। চীনের মদদ ছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে স্মরণকালের নৃশংস গণহত্যা কখনও সংঘটিত করতে পারত না, পক্ষান্তরে ভারত গণহত্যার ভিকটিম বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধকালে আশ্রয় দিয়ে মানবতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। চীন কখনও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, বরং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে বার বার ভেটো দিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আমরা যেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ও জাতির পিতাকে ভুলে না যাই।’

 

প্রাক্তন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে পাকিস্তান ও চীনের মদদ ছিল এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট।। বিনিয়োগের নামে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশে উপনিবেশসুলভ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাইছে চীন। চীনের বিনিয়োগ রাজনীতি ও দুরভিসন্ধি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

 

ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন আছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সহায়তাকে পৃথিবীতে অনেক অর্থনীতিবিদ ঋণের ফাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেন। অর্থনীতির বিষয়টি রাজনীতির বাইরের কোনো বিষয় নয়। আর এর সঙ্গে দুর্নীতি যদি যুক্ত হয় সেটা একটা নতুন মাত্রা পায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে এখনো কাজ করছে। বিভিন্ন দেশের অভিযোগ, চীনারা ঘুষ দিয়ে কাজ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2